৷৷ সন্দীপ বিশ্বাস৷৷ আগরতলা, ৯ ফেব্রুয়ারী৷৷ সরকারী অনুষ্ঠানের সুযোগে নির্বাচনী প্রচার সেরে নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ নতুন ভারত গড়বেন, এই দাবিতে ভোট চাইলেন তিনি৷ শনিবার রাজ্য সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেছেন৷ সমান তালে বিরোধীদেরও একহাত নিয়েছেন৷ মোদি সরকারের বিষয়ে ভুল বুঝানো হচ্ছে, সবাইকে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী সওয়াল করেন, ৫৫ বছরে যে কাজ হয়নি ৫৫ মাসেই তা করে দেখিয়েছি আমরা৷ তাই, মহাভেজালের মাধ্যমে বিভ্রান্ত হওয়ার বদলে শক্তিশালি সরকারের পক্ষেই জনাদেশ দেওয়ার আবেদন জানালেন প্রধানমন্ত্রী৷ একই সাথে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এবং তাঁর পুরো টিমের পিঠ চাপড়িয়েছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, দুই দশকে রাজ্য উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলেও, পরিবর্তনের পর থেকেই নতুন দিশায় এগিয়ে চলেছে ত্রিপুরা৷ এখানেই থেমে থাকেননি প্রধানমন্ত্রী৷ ত্রিপুরাবাসীর কাছে স্বপ্ণও ফেরী করেছেন৷ তাঁর দাবি, খুব শীঘ্রই গোমতিতে জাহাজ আসছে৷ ফলে, ত্রিপুরা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক হাব হয়ে উঠা এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা৷
রাজ্য সফরে এসে এদিন প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বিমান বন্দরে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন৷ এরপর তিনি বিকেলে আগরতলার স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে গর্জি-বিলোনীয়া রেলওয়ে লাইন জাতির প্রতি উৎসর্গ এবং নরসিংগড়ের ত্রিপুরা ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির নতুন কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করেন৷ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের উপর লেখা হিন্দি ও বাংলা বই দুটির আবরণও উন্মোচন করেন৷
প্রধানমন্ত্রী আজ ভাষণে সাড়ে চার বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের এবং ১১ মাসে রাজ্য সরকারের সাফল্য তুলে ধরে বিরোধীদের বিঁধেছেন৷ তাঁর কথায়, ত্রিপুরার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের উদ্যোগের কোনও ঘাটতি নেই৷ গত সাড়ে চার বছরে এই লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া হয়েছে৷ রাজ্যের পূর্বতন সরকারের দুর্বলতার জন্য এখানে ওই সময় এই অর্থের সদ্ব্যবহার হয়নি৷ কিন্তু, বর্তমান সরকার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী৷ সাথে যোগ করেন, রাজ্যে এই প্রথম নূ্যনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে৷ তিনি বিদ্রুপের সুরে বলেন, এটা খুবই অবাক হওয়ার মতো বিষয় যে দিল্লিতে যারা অনেক কিছু বলে ভাষণ দেন তারা এতোদিন রাজ্যে এই কাজটি করেননি৷ তাই, দেশবাসীর এই সমস্ত লোকেদের চিনে উচিৎ, মনে করেন তিনি৷
প্রধানমন্ত্রীর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের নেতৃত্বে নতুন সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় এসে রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশনের সুুপারিশ কার্যকর করেছে৷ এর আগে রাজ্যে যারা ক্ষমতাসীন ছিলো তারা শ্রমিকদের স্বার্থে নানা কথা বললেও বেতন কমিশনের সুুপারিশ কার্যকর করেনি৷ তিনি প্রত্যয়ের সাথে বলেন, এখন ত্রিপুরা দেশের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে৷ আজ যে প্রকল্পগুলির সূচনা করা হয়েছে এর সঙ্গে যুবকদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে৷ তাঁর বক্তব্য, এর আগে ত্রিপুরা সফরে এসে রাজ্যে হিরা আনার কথা বলেছিলাম৷ হিরা কথার অর্থ হাইওয়েজ, আইওয়েজ, রেলওয়েজ এবং এয়ারওয়েজ৷ হামসফর, দেওঘর এক্সপ্রেস, এয়ারপোর্টের নির্মীয়মান নতুন টার্মিনাল ভবন তারই অঙ্গ৷ আজ যে প্রকল্পগুলির সূচনা হলো সেগুলি সবই হিরা মডেলের নমুনা৷ বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরায় নতুন কাজ আসবে৷ এখানে শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনাও প্রশস্ত হচ্ছে, আত্মবিশ্বাসের সাথে দাবি প্রধানমন্ত্রীর৷
তাঁর মতে, ত্রিপুরাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন গেটওয়েতে পরিণত করা হবে৷ ফেণী নদীর উপর বীজটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে গেলে এবং গোমতী নদীর নাব্যতা বাড়ানো হলে ত্রিপুরা শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চল নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক হাবে রূপান্তিরত হবে৷ সাথে যোগ করেন, গোমতী নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে এতে জাহাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, গোমতী নদী আগেও ত্রিপুরায় ছিলো৷ কিন্তু, কেন এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ একইসাথে এর জবাবও দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, প্রযুক্তির সাহায্যে মানুষের জীবনকে আরও সহজ করার চেষ্টা করছে বর্তমান সরকার৷ ত্রিপুরায় বাষট্টি হাজারেরও বেশি এমন লোকের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের অস্তিত্ব শুধু কাগজে কলমেই ছিলো এবং তারা নানারকম সুুযোগ সুুবিধা ভোগ করতেন৷ এই লোকেরা সাধারণ মানুষের পয়সা লুটে খেয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর দাবি, গত সাড়ে চার বছরে সারা দেশেই এমন ৮ কোটি মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে যারা বেআইনীভাবে গরীবদের নানা রকম সুুযোগ সুুবিধা ভোগ করতো৷ প্রযুক্তির সহায়তায় এরকম লোকজনদের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং তাদের চিহ্ণিত করে বিভিন্ন ধরণের সুুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে৷
এদিন প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, গত সাড়ে চার বছরে কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের কল্যাণে যে কাজ করেছে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সসম্প্রতি সংসদে পেশ করা বাজেটে বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ সবার জন্য এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যা আগে কেউ চিন্তা করেনি৷ সবকা সাথ সবকা বিকাশ এই শ্লোগানকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে৷ প্রধানমন্ত্রীর কথায়, এই বাজেটে এমন অংশের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে যাদের জন্য এতোদিন শুধু শ্লোগান দেওয়া হতো৷ এতোদিন অসংগঠিত অংশের শ্রমিকদের জন্য কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বাজেটে এই অংশের লোকেদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করেছে৷ ’প্রধানমন্ত্রী শ্রমযোগী মানধন যোজনা’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে যাতে শ্রমিকদের জন্য মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ ষাট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তারা তিন হাজার টাকা করে মাসে পেনশন পাবেন৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষক ও মৎস্যজীবি সহ বিভিন্ন অংশের লোকেদের জন্য উন্নয়নমূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে৷ কৃষকদের জন্য ’পিএম কিষাণ যোজনা’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে যাতে ত্রিপুরা সহ সারা দেশের ৫ কোটি কৃষক পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় উপকৃত হবেন৷ তাদের জন্য প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার ৬ হাজার টাকা করে জমা করবে৷ ২ হাজার টাকা করে তিন কিস্তিতে এই টাকা কৃষকদের দেওয়া হবে৷ প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রথম কিস্তির টাকা দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে৷ যাদের কাছে ৫ একর বা এর কম জমি আছে তারাই এই প্রকল্পের আওতায় আসবেন৷ পশুপালকদেরও কৃষকদের মতো করে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড দেওয়া হবে যাতে তারা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে পারেন৷ তিনি বলেন, মৎস্যজীবীদের জন্য পৃথক দপ্তর খোলা হবে যাতে তাদের বিভিন্ন সমস্যার সহজেই সমাধান করা যায়৷ তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গরীবদের জন্য ঘর, শৌচালয় ইত্যাদি তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী উজ্জলা যোজনার মাধ্যমে তাদের বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে৷ খব অল্প টাকার প্রিমিয়ামের মাধ্যমে বীমা চালু করা হয়েছে যার আওতায় সবাই আসতে পারেন৷ প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এগারো মাসে ত্রিপুরায় প্রধানমন্ত্রী উজ্জলা যোজনায় ২ লাখের বেশি গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে৷ কুড়ি হাজারের বেশি ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সোয়া লাখের বেশি শৌচালয় নির্মাণ করা হয়েছে৷
ত্রিপুরাকে নিয়েও কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্ট সংবেদনশীল, তা তথ্য দিয়ে বুঝিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তাঁর কথায়, জনজাতিদের জন্য ত্রিপুরার একটা আলাদা পরিচিতি রয়েছে৷ সাম্প্রতিক পেশ করা কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে জনজাতিদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে৷ জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করার দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করা হয়েছে৷ সাথে জেলা পরিষদের অধিকার বাড়ানো হয়েছে৷ তাতে জনজাতি এলাকার উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন৷ সাথে যোগ করেন, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশুনা, যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান, কৃষকদের জন্য সেচের ব্যবস্থা যথাযথভাবে করার লক্ষ্যে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কাজ করছে৷ ত্রিপুরায় শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বর্তমান রাজ্য সরকার ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য রাজ্যে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ আগে শুধু একটি দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরই চাকরি দেওয়া হতো৷ এখন ত্রিপুরায় যুবকদের মেধার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হচ্ছে৷ তাঁ দাবি, ত্রিপুরায় হিংসার দিন শেষ৷ সবাই এখন পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে সব ধরণের উৎসবে সামিল হতে পারছেন৷ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মা ত্রিপুরাসুুন্দরীর মাটিতে আরও একবার আসার সুুযোগ হলো৷ ১১ মাস আগে রাজ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তার আনন্দ সবার চেহারায় দেখা যাচ্ছে৷ এই এগারো মাসে রাজ্যের মানুষ গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সঠিক ছোঁয়া অনুভব করছেন৷ উন্নয়নের ক্ষেত্রে ত্রিপুরাকে এক নতুন রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা সহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে বাহবা দিয়েছেন৷ প্রধানমন্ত্রী এদিন, বিরোধীদের একহাত নিয়েছেন৷ ৫৫ বছরের সরকার যা করতে পারেনি ৫৫ মাসে বিজেপি সরকার তা করে দেখিয়েছে৷ এই দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন৷ তাঁর কথায় মহা ভেজাল নেতারা এখন দিল্লীর মসনদে বসার স্বপ্ণ দেখছেন৷ তাতে দেশবাসী শুধু অসহায় সরকার পেতে পারেন৷ প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, এখন মোদিকে গালি দেওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে৷ অথচ মহা ভেজাল জোটে যারা রয়েছেন তারা ত্রিপুরা, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে একে অপরকে দেখেন না৷ তাঁর দাবী দেশবাসীকে বিভ্রান্তি সরকার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছেন বিরোধীরা৷ কিন্তু, বিভ্রান্ত হওয়ার বদলে শক্তিশালী সরকারের পক্ষে জনাদেশ দেওয়া হোক, আবেদন জানান প্রধানমন্ত্রী৷