এনআরসি-র প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে আলোচনা সভা ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন তরুণ গগৈ

কলকাতা, ১৭ ডিসেম্বর (হি.স.) : এনআরসি নিয়ে প্রশ্নের জেরে খেই হারিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। সোমবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক আলোচনাকক্ষ থেকে রীতিমত চেঁচামেচি করতে করতে তিনি বেড়িয়ে যান।
এ দিন আলোচনার বিষয় ছিল ‘গণহত্যা, আত্মহত্যা ও এনআরসি’। উদ্যোক্তা ছিল ‘দলিত ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন পরিষদ’। তরুণ গগৈ ছাড়াও এতে অংশ নেন কংগ্রেস নেতা ওমপ্রকাশ মিশ্র, সিপিএমের পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ, অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য প্রমুখ। ছিলেন হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অসমের খসরা নাগরিকপঞ্জী(এনআরসি) নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ দিন কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ আগাগোড়া এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করতে থাকেন। তিনি বলেন, “এটা ভারতের মানুষের মৌলিক অধিকার ও সংবিধানের বিরোধী। এই ভাবে বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারী চিহ্ণিত করা যায় না।”
তরুণবাবু দাবি করেন, অসমের থাকার সময় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিলাম ২০১৪-র ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম আছে, তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। এখনও আমি বলছি ওঁরা ভারতের নাগরিক। কিন্তু এ রকম বেশ কয়েক লক্ষ লোকের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ওঁদের সবাইকে আশ্বস্ত করছি। আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। কারণ, কোনও রাজনৈতিক দল ওঁদের ভোটার কার্ড দেয় নি। সংবিধান-স্বীকৃত বিভাগ এই স্বীকৃতি দিয়েছে।
তরুণবাবু এদিন বলেন, আমরা অসমে শান্তিতে বাস করছি। কিন্তু জাতপাত, ভাষা প্রভৃতির প্রশ্ন তুলে অশান্তি তৈরির চেষ্টা করছে। অমিত শাহ দাবি করেছেন, অন্তত ১৪ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী বেআইনিভাবে অসমে আছে। জানি না, জেনে না না জেনে উনি এ সব কথা বলছেন। অযথা দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। এ জিনিস চলতে পারে না। বিভক্তির রাজনীতি করে ভোটে জেতার চেষ্টা সফল হবে না।
এদিন সভায় তৃণমূল কংগ্রেস, আমরা বাঙালি, আরপি আই প্রভৃতির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তরুণবাবুর বক্তব্যের শেষ না হতেই তাঁদের সঙ্গে কিছু সাংবাদিক ও শ্রোতা তাঁকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। মূল প্রশ্ন ছিল, আপনার আমলেই তো গতি পেয়েছিল এই এনআরসি প্রক্রিয়া। ওই সনয় তো আপনার সুর অন্য রকম ছিল? একসময় আপনিই তো বলেছিলেন এনআরসি আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত?
এ সব প্রশ্নের সঠিক এবং যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিতে পেরে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তরুণ গগৈ। কখনও বলেন, “আমার সময় নয়, আরও আগে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।“ কখনও বলেন, “ওটা ছিল দিল্লির পরিকল্পনা।“ এর পর আসন ছেড়ে মঞ্চ থেকে উত্তেজিত হয়ে নেমে কক্ষত্যাগ করার চেষ্টা করেন। তাঁর সঙ্গে প্রশ্ন করতে করতে তাঁর গা ঘেঁষে এগিয়ে আসেন প্রশ্নকর্তারা।
এই সময় মঞ্চ থেকে তিস্তা শীতলাবাদ তরুণবাবুর বক্তব্যের সমর্থনে কিছু বলার চেষ্টা করেন। ওমপ্রকাশ মিশ্র, উদ্যোক্তারা কয়েকজন ও তরুণবাবুর দেহরক্ষী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরে বার করে আনেন। চেঁচাতে থাকেন তরুণবাবু। বলেন, “আপনাদের এ রাজ্যের চেয়ে আমরা অনেক বেশি মানবিক।“ বাইরে বেড়িয়েও চলতে থাকে উত্তপ্ত বাগবিতন্ডা। এই অবস্থায় সভার কাজ বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে।
পরে ভাষণ দেওয়ার সময় ওমপ্রকাশবাবু প্রশ্নকর্তাদের ‘বিজেপি-র লোক’ বলে চিহ্ণিত করে প্রশ্ন করেন, “কোথায় ওরা? চলে গিয়েছে? তরুণ গগৈ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। এটা প্রশ্নকর্তাদের মাথায় রাখা উচিত ছিল।“
সুজনবাবু তাঁর ভাষণে এ দিন বলেন, “এনআরসি বিষয়টা এখন একটা আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে উঠেছে। সমস্যার দ্রুত সমাধান না করলে জটিলতা দেখা দেবে। অসমে মানুষের মনে একটা চূড়ান্ত অসহায়তা চলছে।“ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ওমপ্রকাশবাবু বলেন, “ভারতের সংবিধানে উদ্বাস্তু বলে কাউকে চিহ্ণিত করার কোনও পথ নির্দেশ করা হয়নি। বিদেশী চিহ্ণিত করে কোনও ভাবে কাউকে দেশছাড়া করা যাবে না। কেবল ধর্মের ভিত্তিতে কিছু সংখ্যালঘু মানুষকে বিদেশি বলে চিহ্ণিত করা যায় না।
অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “সংবিধানের ৯১ (ই) ধারা অর্থাৎ নাগরিকত্বের মৌলিক অধিকারের নিয়িখে এনআরসি-র গ্রহণযোগ্যতা নেই। পুরো প্রক্রিয়াটা সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে হওয়া উচিত। কিন্তু যে অবস্থা দেখা দিয়েছে, তাতে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে সামগ্রিক নজরদারি সম্ভব হচ্ছে না।“
তিস্তা শীতলবাদ এ দিন আলোচনায় বলেন, “বিহারের এবিভিপি কর্মীরা এ রাজ্যে এসে এনআরসি নিয়ে প্রচার করছে। এর প্রতিবাদে দলমত নির্বিশেষে সকলে সতর্ক হোন।“ তপোধীর ভট্টাচার্য অভিযোগ করেন, “আমি অসমের নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির সভাপতি। কীভাবে এনআরসি তালিকায় নাম তুলতে হয়, সাধারণ মানুষকে সে সব জানাতে বিভিন্ন অঞ্চলে শিবির করেছিলাম। কিন্তু সেগুলিকে কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে।“