বিধানসভায় সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে জোর বাকবিতন্ডা, ওয়াকআউট, প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, অভিযোগে সরব বিরোধীরা, বাম আমলের বোঝা দায়ী, খন্ডনের চেষ্টা অর্থমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৭ নভেম্বর৷৷ কর্মচারী রাজনীতি বরাবরই বিরোধীদের হাতিয়ার৷ ফলে, সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছেন না বিরোধীরা৷ বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকারকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিয়ে বিধানসভায় সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে রাজ্য সরকারকে কোনঠাসা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন বিরোধীরা৷ কিন্তু, ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁরাই কর্মচারী বঞ্চনা করেছেন, তাই ইচ্ছে থাকলেও কর্মচারীদের পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি, দাবি করেন অর্থমন্ত্রী তথা উপ-মুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা৷ তাঁর দাবি, বাম আমলের বোঝার কারণেই সপ্তম বেতন কমিশন হুবুহু দেওয়া সম্ভব হয়নি৷ মঙ্গলবার বিধানসভায় বিরোধীরা অভিযোগ করেন, সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে প্রতারণা করছে রাজ্য সরকার৷ তেমনি বিরোধীদের এই অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়ে রাজ্য সরকারের দাবি, কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিরোধীরা ময়দানে নেমেছেন৷ সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে বিরোধীরা আজ এতটাই আগ্রাসী ছিলেন যে, উপাধ্যক্ষ এই ইস্যুতে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার সুযোগ না দেওয়ায় বিরোধীরা উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ এনে বিধানসভা অধিবেশন ওয়াকআউট করেন৷

আজ বিধানসভায় বিধায়ক বাদল চৌধুরী সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ সংক্রান্ত উল্লেখপর্বে উত্থাপিত নোটিশের জবাবে অর্থমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা জানান, বর্তমান বিজেপি-আইপিএফটি সরকার তার প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতনাদির দীর্ঘ বঞ্চনার অবসান ঘটানোর জন্য অবসরপ্রাপ্ত আইএএস পিপি ভার্মার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে৷  গত ৫ অক্টোবর কমিটি তার রিপোর্ট সরকারের নিকট জমা দেয়৷

ভার্মা কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার গ্রুপ-সি পদের কর্মচারীদের জন্য নূ্যনতম বেতন প্রতিমাসে ১৮০০০ টাকা করা হয়েছে যা কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রুপ সি পদের কর্মচারীদের  নূ্যনতম বেতনের সমতুল্য৷ তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের কোন গ্রুপ ডি পদ নেই৷ কিন্তু, রাজ্য সরকারের গ্রুপ ডি পদের কর্মচারীদের নূ্যনতম বেতন প্রতিমাসে ১৬০০০ টাকা সংশোধিত করেছে৷ ভার্মা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর ২৫৭ রাখা হয়েছে৷  কিন্তু পে ম্যাট্রিক্স এর যে সকল লেভেলে ২৫৭ মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর দেওয়ার পর কেন্দ্রীয় বেতনক্রমের অধিক হয়ে যাচ্ছে বলে দেখা গেছে, সে সকল ক্ষেত্রে সাম্যতা বজায় রাখার জন্য মাল্টিপ্লিকেশন ফ্যাক্টর  এডজাস্ট করা হয়েছে৷ অর্থমন্ত্রী আরও জানান, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ভাতাদির ব্যাপারে এই মুহূর্তে  এক্সপার্ট  কমিটি সুপারিশক্রমে পূর্বতন হারেই ভাতাদি চালু রেখেছে৷  রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থার উপর বিবেচনা করে ভাতাদির ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে রাজ্য সরকার৷ বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী, গত ৬ নভেম্বর রাজ্য সরকারের অর্থ দপ্তর সংশোধিত হারে বেতন দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার পর থেকে এখন অবদি অর্থ দপ্তরে কাছে বেতন  সম্পর্কিত কোন অসঙ্গতি জমা পড়েনি৷ এছাড়াও এক্সপার্ট কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্য সরকারের একটি অ্যানামলি কমিটি গঠন করার পরিকল্পনা রয়েছে৷

অর্থমন্ত্রী জানান, কর্মচারীদের জন্য রাজ্য সরকার বাজেটে ১০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ রেখেছিল৷ কিন্তু তা ছিল রিসিপ্ঢস এস্টিমেট এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে৷ চর্তুদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুসারে এই অর্থ বছরে শেয়ার অফ ট্যাক্সেস পাওয়ার কথা ছিল ৫৭৪৭০০ কোটি টাকা৷  গত সাত মাসে  শেয়ার অফ ট্যাক্সেস পাওয়া গেছে মাত্র ৭৭৩৩৯ কোটি টাকা৷ অর্থমন্ত্রীর দাবি, তবুও রাজ্য সরকার এরিয়ার দিতে পারত না যদি না বিগত বামফ্রন্ট সরকার এই বিশাল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি এবং ঋণের দায় না রেখে যেত৷

অর্থমন্ত্রী বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারেননি বিরোধী বিধায়করা৷ বিধায়ক বাদল চৌধুরী, বিধায়ক তপন চক্রবর্তী এবং বিধায়ক ভানুলাল সাহা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিয়ে কর্মচারীদের সাথে বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে আভিযোগ আনেন৷ বিধায়ক বাদল চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় বেতনক্রম অনুসারে ১ জানুয়ারী ২০১৬ থেকে কার্যকর হওয়া উচিৎ ছিল৷ কিন্তু, রাজ্য সরকার বর্দ্ধিত বেতনক্রম ১ অক্টোবর ২০১৮ থেকে কার্যকর হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে৷ শুধু তাই নয়, নয়া বেতনক্রমের সুবিধা পিএসইউগুলি এবং এডিসি প্রশাসনের কর্মচারীরা পাননি৷ বাদলবাবুর কথায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সপ্তম বেতন কমিশন হুবুহু লাগু হয়নি৷ আরওপি দেখে বোঝা গেছে, কেন্দ্রীয় হারে বেতনক্রমের সাথে রাজ্যে সংশোধীত বেতন ক্রমের অনেকটাই ফারাক রয়েছে৷ বিধায়ক ভানুলাল সাহা তাতে আরও যোগ করেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের পাওয়ার কথা ছিল, পে বেন্ড-১ ৬৬ হাজার টাকা, পে বেন্ড-২ ৮১ হাজার টাকা, পে বেন্ড-৩ ১লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা এবং পে বেন্ড-৪ ২ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা৷ অথচ, তার কোনটাই সংশোধীত বেতন ক্রমে প্রতিফলিত হয়নি৷ তাঁর দাবি, বামফ্রন্ট সরকার সংশোধীত বেতনক্রম ২২৫ রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের সাথে পিএসইউ গুলি এবং এডিসি প্রশাসনের কর্মচারীদেরও প্রদান করেছে৷ কিন্তু, বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার এখনও পর্যন্ত পিএসইউগুলি এবং এডিসি প্রশাসনের কর্মচারীদের জন্য সংশোধীত বেতনক্রম ঘোষণা করেনি৷ তিনি দাবি করেন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কেন্দ্র শেয়ার অফ ট্যাক্সেসের অনেকটাই বরাদ্দ করেনি৷ নয়তো বা কর্মচারীদের সংশোধীত বেতনক্রম ২৫৭ হারে আমরাই দিতে পারতাম৷ তাঁর আরো দাবি, গ্যাপ গ্রেন্ট থেকে ৭৫৬ কোটি টাকা পেলেও খরচ হয়েছে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা৷ বাকি ৪৫৬ কোটি টাকা থাকা সত্বেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা কেন মিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে না৷

বিরোধীরা এদিন সপ্তম বেতন কমিশন ইস্যুতে সরকার পক্ষকে চাপে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও তাদের সমস্ত অভিযোগ খন্ডনেরও চেষ্টা করেছেন উপ মুখ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রী৷ রাজ্য সরকারের বিরোধীদের সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দেয়৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুদীপ রায় বর্মন বলেন, কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে মিথ্যা রটানো হচ্ছে৷  তাঁর দাবি, রাজ্যের আর্থিক অবস্থা করুণ হওয়া সত্বেও প্রতিশ্রুতি পূরণে সব রকম চেষ্টা করেছে রাজ্য সরকার৷ সপ্তম বেতন কমিশনের জন্য যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ আদায়  করা সম্ভব হবে৷ তাঁর সাফ কথা, বিরোধীরা বিধানসভাকে বিভ্রান্ত করছেন৷ অর্থমন্ত্রীও এদিন বিরোধীদের সমস্ত অভিযোগ খন্ডন  করেন৷ তাঁর দাবি, বাম আমলের আর্থিক বোঝার কারণেই সপ্তম বেতন কমিশন হুবুহু দিতে পারেনি সমস্ত ভাতা ও এরিয়ার দেওয়া সম্ভব হত যদি বামেরা বিরাট অর্থের বোঝা না রেখে যেতেন৷ তাঁর বক্তব্য, পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার ১৬০০ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি এবং ১২০০০ কোটি টাকার ঋণের বোঝা রেখে গেছেন৷ সেই বোঝা আমাদের বইতে হচ্ছে৷ তা সত্বেও প্রতিশ্রুতি পূরণে বিজেপি-আইপিএফটি সরকার যথেষ্ট আন্তরিক৷

অর্থমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে সমস্ত অভিযোগের খন্ডনের চেষ্টা করলেও বিরোধীরা সরকার পক্ষের  এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট বিবৃতি দাবি করলে উপাধ্যক্ষ তাদের সুযোগ দিতে চাননি৷ উপাধ্যক্ষ বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন এই অভিযোগ এনে বিরোধীরা বিধানসভা অধিবেশন বয়কট করে বেরিয়ে যান৷ বিধানসভা অধিবেশনে প্রথমার্ধ সমাপ্ত হওয়া পর লবিতে বিধায়ক বাদল চৌধুরী, বিধায়ক তপন চক্রবর্তী এবং বিধায়ক ভানুলাল সাহা সপ্তম বেতন কমিশন নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্য সরকারকে আবারও তুলোধুনো করেছেন৷ প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়ায় উপাধ্যক্ষ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করেছেন বলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন৷ এই আচরণ গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ বলে দাবি করেন তপনবাবু৷ তিনি উপাধ্যক্ষকে নিশানা করে বলেন, অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারি মনোভাব নিয়ে বিধানসভা পরিচালনা করা হচ্ছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *