ভারতের ৭১তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির ভাষণ

নয়াদিল্লি, ১৪ আগস্ট ।। জাতি গঠনের কাজে নিয়োজিত প্রিয় সহ-নাগরিকবৃন্দ, আমাদের স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আপনাদের জানাই আমার অভিনন্দন।

জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতির ভাষণ।

আগামীকাল আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭০তম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হবে। এই স্বাধীনতা বার্ষিকীর পূর্ব সন্ধ্যায় আপনাদের সকলের উদ্দেশে জানাই আমার শুভ কামনা।

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট আমরা স্বাধীন জাতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলাম। আমাদের নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে যাবতীয় দায়িত্ব ও সার্বভৌমত্ব ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে ন্যস্ত হয় আমাদের ওপর। কেউ কেউ এই প্রক্রিয়াকে ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’ বলেও বর্ণনা করে থাকেন।

কিন্তু আমার কাছে এই ঘটনা আরও বেশি তাৎপর্যময়। তা ছিল, দেশের এক বিশেষ স্বপ্ন পূরণ – যে স্বপ্নকে লালন করে এসেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। আমাদের দেশকে কল্পনায় সাজিয়ে তুলে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম।

এই প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, এক স্বাধীন ভারত গঠনের মূল প্রোথিত ছিল দেশের সাধারণ গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের কল্যাণ এবং সেই সঙ্গে দেশের সার্বিক বিকাশ প্রচেষ্টার মধ্যে।

এজন্য আমরা ঋণী দেশের অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে, যাঁদের মহান উৎসর্গই আমাদের জন্য এই ভিত গঠন করে দিয়েছে।

চেন্নাম্মা, কিত্তুরের রানী, ঝাঁসির লক্ষ্মী বাঈ, মাতঙ্গিনী হাজরা – এঁরা সকলেই ছিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শহীদ ও বীর সেনানী। তাঁদের মতোই এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্তই রয়েছে এদেশে।
মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন সত্তরোর্দ্ধ এক বৃদ্ধা নারী। এক শান্তিপূর্ণ মিছিলের নেত্রীত্বদানকালে বাংলার তমলুকে উপনিবেশবাদী পুলিশ তাঁকে গুলিবিদ্ধ করে। ‘বন্দে মাতরম্‌’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে করতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর হৃদয়ের অন্তস্থলে জাগরূক ছিল এক স্বাধীন ভারতের উচ্চাশা।

[vsw id=”jWwkk_p2ddo” source=”youtube” width=”425″ height=”344″ autoplay=”yes”]সর্দার ভগৎ সিং, চন্দ্র শেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খান, বীরসামুন্ডা এবং তাঁদের মতোই আরও হাজার হাজার স্বাধীনতার যোদ্ধা জাতির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন। আমরা কখনোই তাঁদের বিস্মৃত হতে পারি না।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের আদিকাল থেকেই বহু বিপ্লবী নেতাকে লাভ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল, যাঁরা দেশের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।

তাঁরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই উচ্চারণ করতেন না। মহাত্মা গান্ধী বিশেষভাবে জোর দিতেন ভারত তথা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার নৈতিক চরিত্র গঠনের ওপর। গান্ধীজির সেই সমস্ত নীতি আজও সমান প্রাসঙ্গিক।

দেশব্যাপী সংস্কার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে গান্ধীজি কখনোই একা ছিলেন না। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন এই কথা বলে যে, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। তাঁর এই কথায় লক্ষ লক্ষ ভারতবাসী তাঁদের সর্বস্ব ত্যাগ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁরই নেতৃত্বে।

ভারতের যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আমাদের কাছে খুবই প্রিয়। কিন্তু এক আধুনিক প্রযুক্তি ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার সহ-অস্তিত্বকেও যে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, একথা বলেছিলেন নেহরুজি।

জাতীয় ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে গেছেন সর্দার প্যাটেল। একইসঙ্গে, সুশৃঙ্খল এক জাতীয় চরিত্র গঠনের ওপরও বিশেষ জোর দিতেন তিনি।

সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, আইনের শাসন এবং শিক্ষার আশু প্রয়োজন সম্পর্কে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন বাবাসাহেব ভীম রাও আম্বেদকর।

এই বিশিষ্ট ও মহান নেতাদের কয়েকজনের দৃষ্টান্ত আমি তুলে ধরলাম মাত্র। এ ধরণের বহু উদাহরণই আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি। যে প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তা ছিল বড়ই বৈচিত্র্যপূর্ণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রতিনিধিত্বকারী নারী-পুরুষ ছিলেন এই প্রজন্মের মধ্যে এবং তাঁদের মধ্যে ছিল রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার এক বিচিত্র সমাহার।

এই ধরণের বীর ও সাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছ থেকেই আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া প্রয়োজন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই শুধুমাত্র দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। জাতি গঠনের কাজে আজ ঐ শক্তি ও মানসিকতা লাভের জন্য আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে।

নীতিগত কর্মপ্রচেষ্টার নৈতিক ভিত, ঐক্য ও শৃঙ্খলার ওপর আস্থা, ঐতিহ্য ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ের ওপর বিশ্বাস এবং আইন ও শিক্ষার শাসনের প্রসারের ওপর গুরুত্ব সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে অংশীদারিত্বের এক বন্ধন গড়ে তুলতে পারে।

আর এইভাবেই সরকার ও নাগরিক, ব্যক্তি ও সমাজ এবং পরিবার ও এক বৃহত্তর সমাজ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের দেশ।

সহ-নাগরিকবৃন্দ

শৈশবকাল থেকেই একটি ঐতিহ্য আমি কখনই বিস্মৃত হইনা, তা হল, কোন পরিবারে বিবাহের অনুষ্ঠান থাকলে সমস্ত গ্রামবাসী তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতেন এবং সাধ্যমতো তাতে অবদানেরও নজির রাখতেন। বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিবাহিত কন্যা বা বধূ হয়ে উঠতেন শুধুমাত্র একটিমাত্র পরিবারেরই কন্যা নয়, তিনি হয়ে উঠতেন গ্রামের সবক’টি পরিবারেরই কন্যার মতো।

গ্রামবাসী এবং প্রতিবেশীরা অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন করতেন এবং বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব সামলে নিতেন। বহু পরিবার থেকেই সাধ্যমতো অবদান রাখার চেষ্টা করা হত। কোন পরিবার হয়তো বিবাহের জন্য খাদ্যশস্য দান করত, কোন পরিবার দান করত শাকসব্জি এবং তৃতীয় অপর কোন পরিবার অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হত।

তখন কোন কাজের যত্ন নেওয়া এবং তাতে মিলেমিশে কাজ করার অনুভূতি যেমন কাজ করত, সেরকমই তাঁরা সকলেই ছিলেন পরস্পর নির্ভরশীল। কেউ যদি তখন প্রতিবেশীর প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, তিনিও তখন তাঁর নিজের প্রয়োজনে খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের কাছ থেকে সেই সাহায্য লাভ করতেন।

কিন্তু বর্তমানে বড় বড় শহরগুলিতে আমাদের প্রতিবেশীরাই অনেক সময় আমাদের কাছে অপরিচিত। কিন্তু গ্রাম বা শহর যাই হোক না কেন, পরস্পরের দেখভাল করা এবং মিলিতভাবে কাজ করার সেই মানসিকতা আবার নতুন করে গড়ে তোলা খুবই জরুরি। এই ব্যবস্থায় এক ভদ্র ও সুখী সমাজ যেমন গড়ে উঠবে, সেইসঙ্গে আরও বেশি সহমর্মিতার সঙ্গে আমরা পরস্পরকে ভালো করে জানার ও বোঝার সুযোগ লাভ করব।

সহ-নাগরিকবৃন্দ

সহমর্মিতা, সমাজ সেবা এবং স্বেচ্ছায় কাজের দায়িত্ব বহন করার এই মানসিক শক্তি কিন্তু ভারতে আজও হারিয়ে যায়নি। দেশে এখনও এমন বহু মানুষ ও সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে যারা দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষদের জন্য নীরবে অনলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।

পথশিশুদের জন্য তাঁরা পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে পারেন, চারপাশের বিভিন্ন পশুপাখির তাঁরা যত্ন নিতে পারেন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষের কাছে তাঁরা পৌঁছে দিতে পারেন কষ্টসাধ্য জলের যোগান। নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং উন্মুক্ত স্থানগুলিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও তাঁরা পালন করতে পারেন। তাঁরা হলেন জাতি গঠনের কাজে যুক্ত প্রকৃত কর্মী। আমাদের উচিৎ তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করা।

সরকারের পক্ষ থেকে নীতির সুফলগুলি যাতে সমাজের সর্বস্তরের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এবং স্থির লক্ষ্যে আমাদের কাজ করে যাওয়া উচিৎ। এই কাজে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে এক অংশীদারিত্বের বন্ধন গড়ে তোলা একান্তই জরুরি :

  • সরকারিভাবে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের সূচনা হয়েছে। কিন্তু এক পরিচ্ছন্ন ভারত গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই। 
  • শৌচাগার নির্মাণ কিংবা শৌচাগার নির্মাণের কাজে সহায়তাদান করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হল এই শৌচাগার ব্যবহারের মাধ্যমে উন্মুক্ত স্থানে প্রাকৃতিক কাজকর্মের অভ্যাস মুক্ত এক ভারত গড়ে তোলা।
  • যোগাযোগ পরিকাঠামোর প্রসার ও উন্নয়নের কাজেও সরকার বর্তমান নিয়োজিত। কিন্তু আমাদের সকলের দায়িত্ব হল জ্ঞানের ঘাটতি পূরণ, সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং শিক্ষা তথা তথ্যের প্রয়োজনের মতো সঠিক উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহার নিশ্চিত করা।
  • ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ – এই চিন্তাভাবনার প্রসারে সরকার আগ্রহী। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব হল আমাদের কন্যাসন্তানদের ক্ষেত্রে যাবতীয় বৈষম্যের অবসান নিশ্চিত করে তাঁদের জন্য ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
  • নতুন নতুন আইন প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে তা বলবৎ করার দায়িত্ব হল সরকারের। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকরই উচিৎ আইনের প্রতি অনুগত নাগরিক হয়ে ওঠা। আর এইভাবেই আইনের শাসনে বিশ্বাসী এক সমাজ গড়ে উঠতে পারে।
  • সরকারি নিয়োগ ও সংগ্রহ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছতা রক্ষার ওপর সরকার বিশেষভাবে গুরুত্বদান করেছে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকরই দায়িত্ব হল প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় অন্তরের বিবেকের প্রতি সাড়া দেওয়া।
  • নানা ধরনের কর আরোপের ব্যবস্থা দূর করে লেনদেনকে আরও সহজ-সরল করে তুলতে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি)-এর রূপায়ণে সরকার সচেষ্ট। আমাদের প্রত্যেকরই দায়িত্ব হল এই বিষয়টিকে দৈনন্দিন লেনদেন তথা বাণিজ্য সংস্কৃতির এক অভিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে মেনে চলা।

পণ্য ও পরিষেবা কর ব্যবস্থায় এই রূপান্তর প্রচেষ্টা যে সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে এজন্য আমি আনন্দিত। আমাদের সকলেরই এই কারণে গর্ববোধ করা উচিৎ যে আমাদের দেওয়া করইবিনিয়োগ করা হয় জাতি গঠনের কাজে – দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের সহায়তাদানের উদ্দেশ্যে, শহর ও গ্রামাঞ্চলের পরিকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং আমাদের সীমান্ত বরাবর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে।

সহ-নাগরিকবৃন্দ

আগামী ২০২২ সালে দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তি উদযাপন। আমাদের জাতীয় সঙ্কল্প হল সেই সময়কালের মধ্যে এক নতুন ভারত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ।

নতুন ভারত – এই কথাটির অর্থ কি? এর অনেকগুলি মাপকাঠি রয়েছে। যেমন, প্রত্যেকটি পরিবারের জন্য বাসস্থান, চাওয়া মাত্রই বিদ্যুতের সুযোগ পৌঁছে দেওয়া, উন্নততর সড়ক ও দূরসঞ্চার ব্যবস্থা, এক আধুনিক রেল নেটওয়ার্ক এবং দ্রুত ও নিরন্তর বিকাশ।

এছাড়াও, রয়েছে আরও অনেক কিছু। নতুন ভারতের চিন্তাভাবনার মধ্যে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন মানবতাবাদী দিকটিকে। এই গুণটি রয়েছে জাতির ডিএনএ-র মধ্যেই। আর এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির প্রকৃত সংজ্ঞা তথা বৈশিষ্ট্য। নতুন ভারতকে হয়ে উঠতে হবে ভবিষ্যৎমুখী এক সমাজ ব্যবস্থা। কিন্তু একইসঙ্গে তার হয়ে ওঠা উচিৎএক সংবেদনশীল সমাজও।

  • গড়ে তুলতে হবে এমন এক সহমর্মী সমাজ ব্যবস্থা যেখানে যাঁরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত ও অবহেলিত- তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি কিংবা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী যাই হোক না কেন – তাঁরা সকলেই যে আমাদের জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার এক বিশেষ অঙ্গ তা স্বীকার করে নেওয়া। 
  • গড়ে তোলা প্রয়োজন এমন এক সংবেদনশীল সমাজ ব্যবস্থা যেখানে আমাদের বিভিন্ন রাজ্য তথা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে যেন একাকিত্ব বা বিচ্ছিন্নতাবোধ দানা বেঁধে না উঠতে পারে। তাঁদের সকলকেই সাদরে গ্রহণ করতে হবে আমাদেরই ভাই বা বোন হিসেবে।
  • আমাদের প্রয়োজন এমন এক সহানুভূতিপ্রবণ সমাজ ব্যবস্থার যেখানে বঞ্চিত শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ প্রবীণ নাগরিক, দরিদ্র এবং বঞ্চিত মানুষদের কথা সবসময়ই থাকবে আমাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে। এঁদের কথা পরে চিন্তা করা হবে, এই মানসিকতা যেন আমাদের মধ্যে না গড়ে ওঠে। এই সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ যত্নবান হতে হবে আমাদের দিব্যাঙ্গ ভাই-বোনদের প্রতি যাতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁরা সমান সুযোগের অধিকারী হতে পারেন।
  • এই সমাজ ব্যবস্থাকে হয়ে উঠতে হবে সমতায় এবং সমান সুযোগের অধিকারে বিশ্বাসী এমন এক সমাজ যেখানে লিঙ্গ বা ধর্ম ভেদে বৈষম্যমূলক আচরণকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
  • আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে হয়ে উঠতে হবে এতটাই সংবেদনশীল যাতে আমাদের মানব মূলধনকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলা যায়, কিশোর ও তরুণদের জন্য সহজসাধ্য বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বার উন্মুক্ত করে তোলা যায়। পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিষেবার গুণগত মানের কোন অভাব যাতে সেখানে অনুভূত না হয়।

আর এইভাবেই আমাদের স্বপ্নের সেই নতুন ভারতকে আমরা গড়ে তুলতে পারব যেখানে প্রত্যেক ভারতবাসী তাঁর নিজস্ব সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ করবেন। এই প্রচেষ্টা আমাদের চালিয়ে যেতে হবে এমনভাবে যাতে সকলেই সুখী ও সন্তুষ্ট থাকেন। সমাজ তথা দেশের প্রতি অবদান সৃষ্টির সুযোগ থাকবে এই ব্যবস্থার মধ্যে।

 আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে এমন এক শক্তিশালী সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যা আমাদের পৌঁছে দেবে নতুন ভারতের লক্ষ্য পূরণে।

 বিমুদ্রাকরণ-পরবর্তী দিনগুলিতে যে বিশেষ ধৈর্য্য ও স্থির বুদ্ধির পরিচয় আপনারা দিয়েছেন এবং দুর্নীতি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকে যেভাবে আপনারা সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানিয়েছেন, তার মধ্যেই প্রতিফলন ঘটেছে দায়িত্বশীল এবং বুদ্ধি ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত আমাদের সমাজ ব্যবস্থার।

 এক সত্যনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তোলার কাজে আমাদের প্রচেষ্টাকে শক্তি যুগিয়েছে এই বিমুদ্রাকরণ। এই মানসিক শক্তি ও তার গুরুত্বকে আমাদের অবশ্যই ধরে রাখতে হবে।

 সহ-নাগরিকবৃন্দ

 প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করা এখন বিশেষভাবে জরুরি। একটিমাত্র প্রজন্মের মধ্যেই জনসাধারণের ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র্য নির্মূল করার লক্ষ্য পূরণে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। নতুন ভারত সম্পর্কে ধারণা ও চিন্তাভাবনার মধ্যে দারিদ্র্যের কোন স্থান নেই।

 বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ভারতের দিকে। এক দায়িত্বশীল বিশ্ব নাগরিক, বিকাশশীল এক অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ও বিপর্যয়, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, মানবতার সঙ্কট, উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানসূত্রেরউদ্ভাবক হিসেবে এখন চিহ্নিত আমাদের এই দেশ।

 আমাদের উত্থানকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার আরেকটি সুযোগ হল ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় টোকিও অলিম্পিক্স। আগামী তিন বছর এই জাতীয় লক্ষ্য পূরণের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়ার সময়। আমাদের প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের চিহ্নিত করে তাঁদের কাছে বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার কাজে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, ক্রীড়া সংগঠন এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির উচিৎ মিলিতভাবে কাজ করে যাওয়া যাতে ঐ খেলোয়াড়রা টোকিওতে আরও বেশি করে সাফল্যের নজির সৃষ্টি করতে পারেন।

 আমরা দেশে বা বিদেশে যেখানেই বসবাস করি না কেন, ভারতের সন্তান এবং নাগরিক হিসেবে আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করতে হবে যে দেশের গৌরব বাড়িয়ে তুলতে আমরা কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারি।

 সহ-নাগরিকবৃন্দ

 পরিবার-পরিজনদের সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা আমাদের পক্ষ খুবই স্বাভাবিক।কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের চিন্তা করতে হবে সমাজের ভালো-মন্দের দিকটিও। শুধুমাত্র কর্তব্যের বাইরেও আমাদের যে অতিরিক্ত কিছু দেওয়ার রয়েছে যেমন আরও বেশি করে নিঃস্বার্থতা – এই আহ্বানের প্রতি সাড়া দিতে হবে আমাদের। একজন মা যখন তাঁর সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করে তোলেন, তখন তিনি তাঁর কর্তব্যই শুধুমাত্র পালন করেন না, নিঃস্বার্থ সেবার এক অনন্য অবদানেরও তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। 

  • তাপদগ্ধ মরুপ্রান্তর কিংবা সুউচ্চ পর্বত শিখরের শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দেশের সীমান্ত প্রহরার কাজে নিযুক্ত রয়েছেন আমাদের সেনাবাহিনী। তাঁরা শুধুমাত্র কর্তব্যই পালন করছেন না, একইসঙ্গে তাঁরা নিঃস্বার্থ সেবার এক বিশেষ মাত্রাও তাতে যোগ করে চলেছেন। 
  • আমাদের পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী মৃত্যুকে অবহেলা জ্ঞান করে সন্ত্রাস ও অপরাধের হাত থেকে আমাদের মুক্ত রাখার সঙ্কল্প নিয়ে কাজ করে চলেছে। তাঁরা শুধুমাত্র তাঁদের কর্তব্যই পালন করছেন না, একইসঙ্গে তাতে যুক্ত করছে নিঃস্বার্থ সেবার এক উচ্চমাত্রা।
  • ভারতবাসীর মুখে অন্ন তুলে দিতে কৃষকরা কাজ করে চলেছেন খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। যাঁদের জন্য তাঁদের এই সেবাপরায়ণতা, তাঁদের সঙ্গে হয়তো কোনকালেই সাক্ষাৎকার ঘটেনি তাঁদের। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁরা এই কাজ করে চলেছেন শুধুমাত্র একটি দায়িত্ব বা কর্তব্য হিসেবেই নয়, একইসঙ্গে নিঃস্বার্থ সেবার এক বিশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্যে।
  • প্রাকৃতিক বিপর্যয়-পরবর্তীকালে দিবারাত্র ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন বহু মানুষ এবং সামাজিক গোষ্ঠী ও সরকারি সংস্থাগুলি। নিঃস্বার্থ পরায়ণতার এর থেকে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে।

আমরা প্রত্যেকেই কি এই নিঃস্বার্থ পরায়ণতার শক্তি নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলতে পারি না?

 হ্যাঁ, আমরা তা পারি এবং আমাদের মধ্যে ঐ শক্তি রয়েছেও।

 প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে ১ কোটিরও বেশি পরিবার রান্নার গ্যাসের ওপর স্বেচ্ছায় ভর্তুকি ছেড়ে দিয়েছে যাতে একটি করে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া যায় সহ-নাগরিক এক দরিদ্র পরিবারের রান্নাঘরে যাতে সেই পরিবারের সদস্যরা বিশেষত মহিলারা, উনুনের ধোঁয়া থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কারণ, এই ধোঁয়া প্রভূত ক্ষতিসাধন করে তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্বাসযন্ত্রের।

 যে সমস্ত পরিবার স্বেচ্ছায় এই ভর্তুকি ছেড়ে দিয়েছেন, তাঁদের আমি সম্মান জানাই। কোন আইন বা সরকারি নির্দেশ কিন্তু তাঁদের এই কাজে বাধ্য করেনি। তাঁরা আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকেই।

 আমাদের অনুপ্রাণিত হতে হবে এই পরিবারগুলির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া। সহায়-সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ভারতীয়দের সাহায্য করার পথ আমাদের নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে।

 জাতি গঠনের লক্ষ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হল আমাদের আগামী প্রজন্মকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত করে তোলা। কোন শিশুই যাতে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত না থাকে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এই কারণে আমি আপনাদের কাছে আর্জি জানাই যে জাতি গঠনের সহকর্মী হিসেবে পর্যাপ্ত সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে। আপনার নিজের সন্তান ছাড়াও অন্য একটি শিশুকেও আপনি শিক্ষাদান করুন। তাদের জন্য বিদ্যালয়ের বেতন কিংবা বই কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন যাতে তা থেকে আপনার নিজের সন্তান ছাড়াও আরেকটি শিশুও উপকৃত হতে পারে। অন্তত একটিমাত্র অপর কোন শিশুর জন্য প্রত্যেকেই এই কাজে এগিয়ে আসুন।

 এক বিশেষ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত আমাদের ভারতবর্ষ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে গড়ে উঠতে চলেছে পূর্ণ সাক্ষরএক সমাজ ব্যবস্থা। এই মানকে আমাদের আরও উন্নীত করে তোলা প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ পূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত এক সমাজ গড়ে তোলা।

 এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য আমরা সকলেই কিন্তু পরস্পরের অংশীদার। এই লক্ষ্য পূরণ যদি আমরা সম্ভব করে তুলতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের রূপান্তর আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারব আমাদের দৃষ্টির সামনেই। এই বিশেষ সংজ্ঞা-নির্ধারক পরিবর্তনের দূত হয়ে উঠব আমরা সকলেই।

 আড়াই হাজার বছর পূর্বে গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন “অপ্পদীপোভবঃ … অর্থাৎ, তুমি নিজেই হয়ে ওঠ এক আলোকবর্তিকা।” তাঁর এই শিক্ষাদর্শকে অনুসরণ করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগকে সঙ্গে নিয়ে যদি আমরা মিলিতভাবে কাজ করে যেতে পারি, তাহলে আমরা ১২৫ কোটি ভারতবাসী একত্রে প্রজ্জ্বলিত করতে পারব সেই আলোকশিখা যা আমাদের পৌঁছে দেবে এক নতুন ভারত গঠনের লক্ষ্যে।

 আমি আরও একবার দেশের ৭১তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আপনাদের সকলকে জানাই আমার শুভেচ্ছা।

 

প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো

ভিডিও সৌজন্যে ঃ ডিডি নিউজ