নিজস্ব প্রতিনিধি, খোয়াই, ১ ডিসেম্বর৷৷ স্বাধীনতার ৭০ বছর পর কেমন বর্তমান খোয়াই জেলার লাকড়ি বিক্রেতারা? যারা
শহর থেকে ২০-৩০ দূর থেকে ভার সিক্কা অর্থাৎ কাঁধে করে নিয়ে আসতেন লাকড়ির ভার৷ যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে লাকড়ির ভার একসময় কাঁধে থেকে নেমে পড়ে বাই সাইকেলে৷ এই মেহনতী মানুষদের কাছে এখনও মিডিয়া পৌঁছেনা৷ কিংবা ক্যামেরার ক্ল্যাস পড়েনা ঘর্মাক্ত শরীরে দূর -দূরান্ত থেকে ছুটে আসা সেইসব রক্তে মাংসে গড়া মানুষগুলোর দিকে৷ লাকড়ি বিক্রেতাদের নিয়ে দুচার অক্ষর কোন লেখক কবি’র মস্তিস্কে ঘর করে না৷ কোন সামাজিক সংস্থা, এনজিও বা কোন রাজনৈতিক দলের স্বপ্ণ দেখানো নেতা-কর্মীরাও পৌঁছেন না তাদের কাছে৷ অথচ একসময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাজার হাঁট করে বাড়ী ফিরলে গৃহিনীদের প্রাথমিক প্রয়োজন ছিল লাকড়ির৷ তবে লাকড়ি হতে হবে শুকনো৷ নতুবা রান্না ভাল হবে না৷ গৃহিনীর কথা শুনতে হবে উপরন্ত ধোঁয়ার ভরে উঠবে ঘর৷ এসব এখন কেমন যেন কাহিনী কাহিনী বলেই মনে হয়৷ কিন্তু কাহিনীর মূল চরিত্ররা কিন্তু এখনও সেই পথেরই পথিক৷ এখনও খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে মূল রাস্তার ধারে রৌদ বৃষ্টি উপক্ষো করে বসে থাকতে দেখা যায় সারিবদ্ধ লাকড়ি বিক্রেতাদের৷ যদিও লাকড়ি বিক্রেতাদের করুন কাহিনী শুনবার অবকাশ খুব কম মানুষের কাছেই আছে৷ ইতিহাস ঘাটলে জানা যায়, রাজার আমলে তৈরী খোয়াই মহারাজগঞ্জ বাজারে (বর্তমান পুরান বাজার) মহিলারা দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় করে আর পুরুষরা কাঁধে করে লাকড়ি নিয়ে আসতেন৷ মাথায় করে আনা বোঝা বিক্রি হতো ৫০-৬০ পয়সা আর ভাড় বিক্রি হতো ১ টাকা থেকে তার বেশী৷ এই লাকড়ি বিক্রি করে কোন প্রকার বাজার হাঁট করে গ্রামে ফিরতেন তারা৷ তৎকালীন সময়ে ছিল ফরেষ্ট এর জুলুম৷ প্রতিদিন লাকড়ি বিক্রেতাদের (ট্যাক্স) দিতে হয়৷ প্রতি কারনে অনেক সময় লাকড়ি বিক্রেতাদের দ্বারা ফরেষ্টার বাবুদের নিগৃহীত হতে হয়েছে৷ তৎকালীন নবোদয় বিদ্যালয়ের কাছে বর্তমান সময়ে মুন্ডা বস্তি এলাকায় ছড়ার ভেতর ফরেষ্টারকে মেরে মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়৷ সেই খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে তখনকার সময়ে সিআইডিকে লাগানো হয়৷ পরে তদন্তক্রমে আসামী জগন্নাথ মুন্ডাকে গ্রেফতার করে পুলিশ এবং ঘটনার ১৫ দিন পর ফরেষ্টারের দেহ ও খুনের জন্য ব্যবহৃত কুড়ালটি মিলে৷ এমন বহু ঘটনার সাক্ষী লাকড়ি বিক্রেতারা৷ শহরমুখী হয়েও এদের অনেককেই অপমান সহ্য করতে হয়েছে দিনের পর দিন৷ বর্তমানেও হচ্ছে৷ ফরেষ্টারের জুলুম, লেবির বিরুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্যবাসী আন্দোলন হয়েছিল৷ গরীব-শ্রমিক-হেমনতি মানুষদের পুঁজি করে সব রাজনৈতিক দলগুলো কম বেশী ক্ষমতা দখলের স্বাদ পেয়ে যাচ্ছেন বা যাবেন৷ কিন্তু উনারা ভুলে গেলেন সেই গরীব-শ্রমিক-মেহনতী মানুষগুলোর কথা৷ যেমন লাকড়ি বিক্রেতা, ক্ষেতমজুর, রিক্সা শ্রমিক, গাড়ী চালক, দোকান কর্মচারী, জুতো কারবারী, বাদ্যকর সহ নানাহ শ্রমিকগুলো আজ দিশেহারা৷
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আজ অবধি লাকড়ি বিক্রেতাদের ঘরের ৯৮ শতাংশ ছেলে -মেয়েরাই মাধ্যমিক গন্ডী টপকাতে পারেনি৷ স্বভাবতই জুটেনি কোন সরকারী চাকুরী৷ বেশ কিছু বিপিএল কার্ড থেকেও বঞ্চিত৷ সরকারী সুযোগ থেকে বঞ্চিত৷ আশ্চর্য্যের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৭০ বছরেও এই সমস্ত লাকড়ি বিক্রেতারা শহরের বাজারে বসার কোন সরকারীভাবে স্থান করে নিতে পারেনি৷ আজ এখানে তো কাল ওখানে৷ দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এদের৷ যদিও রিক্সা চালকরাও কোন নিদিষ্ট করে সরকারী স্থান পায়নি৷ ১৯৭৮ই বামফ্রন্টের খোয়াইয়ের প্রথম বিধায়ক কামিনী সিংহ মহাশয় চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন এবং বর্তমান শ্রীকৃষ্ণ মন্দির স্থলেই স্থান করে দিয়েছিলেন রিক্সা চালকদের জন্য৷ একটি শেড ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন৷ কিন্ত পরবর্তী সময় কিছু ভোটের জন্য রিক্সা শ্রমিকদের রৌদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থরিট কেড়ে নেওয়া হয়৷ তারপর থেকে আজ অবধি আর কোন জায়গা পাননি রিক্সা চালকরা৷ একই প্রকার খোয়াই জেলায় লাকড়ি বিক্রেতাদের জন্যও কোন নিদিষ্ট স্থান হয়নি৷ অথচ এই পেশায় উপজাতি, হিন্দুস্তানী সম্প্রদায়ের মানুষই বেশী৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি শুধু জনসভা, পথসভায় গরীব-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কথা বলে৷ বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্য কথাই বলছে৷ তাই সময় ফুরিয়ে যাবার আগে এদের দিকেও তাকাতে হবে৷ নয়তো পাহাড় ভাঙলে, শহর ভাঙতে কতক্ষন৷