নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৯ জুলাই৷৷ পেট্রোল বিদ্রোহে রাজ্য সরকার চরম বেকায়দায় পড়েছে৷ দিনভর রাজধানী
আগরতলা পেট্রোলের দাবীতে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল৷ রাজপথে ছিল কেবল টায়ার পোড়া গন্ধ৷ রাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে পৃথক স্থানে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ৷ সকালেই বিদ্রোহের আগুনের আঁচ মহাকরণ পর্যন্ত ছড়িয়েছে৷ তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে খাদ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য সরকারের তিন মন্ত্রী পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করলেও এই সমস্যার সমাধানে সঠিক কোন দিশা দেখাতে পারেননি৷ তবে, যারা পেট্রোল নিতে গিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছেন তাদের চিহ্ণিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন খাদ্যমন্ত্রী৷ পাশাপাশি প্রত্যাশা মতোই কেন্দ্রের দিকে এই সমস্যার দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে দায়বদ্ধতার বিষয়টি মনে করিয়ে দেন খাদ্যমন্ত্রী, পূর্তমন্ত্রী এবং পরিবহণ মন্ত্রী৷
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পেট্রোল নিতে এসে দ্বিচক্র যান চালকরা আন্দোলনমুখী হন৷ রাস্তা অবরোধ করেই থেমে থাকেননি তারা৷ সকাল থেকে বেশ কয়েকবার রাজধানীর কয়েকটি স্থানে পোড়ানো হয়েছে টায়ার৷ লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির সংলগ্ণ রাস্তা, বড়দোয়ালী, গণরাজ চৌমুহনী, আরএমএস চৌমুহনী, রাধানগরে পেট্রোল নিতে এসে যান চালকরা অবরোধ করেছেন৷ সন্ধ্যায় আরএমএস চৌমুহনী এবং দুর্গাবাড়িস্থিত পেট্রোল পাম্পে ক্ষুব্ধ যান চালকরা পুনরায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফায়ার ব্রিগেডকে ছুটে আসতে হয়েছে৷ শুধু তাই নয় ক্ষুব্ধ যান চালকদের শান্ত করতে রাস্তায় নামতে হয়েছে জেলা শাসক এবং আই জি (আইন শৃঙ্খলা)কে৷ রাতে ক্ষুব্ধ যান চালকরা ঘেরাও করেন মুখ্যমন্ত্রীর সরকারী আবাসন৷ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশকে লাঠিচার্জও করতে হয়েছে৷ এদিকে, রাতেই শহরের গণরাজ চৌমুহনীতে ক্ষুব্ধ যান চালকরা পথ অবরোধ করে টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ এখানেও বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে৷
মোট কথা, এদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গোটা রাজধানী যান চালকদের ক্ষোভের আগুনে জ্বলেছে৷ প্রশাসনের কর্তারা রীতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েন৷ জেলা শাসক থেকে শুরু করে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ কারোরই সান্তনা বার্তা পেট্রোল নিতে আসা যান চালকদের আশ্বস্থ করতে পারেনি৷ সন্ধ্যায় দূর্গবাড়িস্থিত পেট্রোল পাম্পের সামনে জনরোষ থামাতে আসেন জেলা শাসক মিলিন্দ রামটেকে, আই জি (আইন শৃঙ্খলা) এস চতুর্বেদি এবং পশ্চিম জেলার পুলিশ সুপার অভিজিৎ সপ্তর্ষি৷ তাঁরা ক্ষুব্ধ যান চালকদের অবরোধ প্রত্যাহার করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার আবেদন জানান৷ এমন কি পাম্পে পেট্রোল আসলেই তাদেরকে সরবরাহ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও বিক্ষোভকারীরা তাতে আশ্বস্থ হননি৷ এদিকে সকালে সিট্যুর নেতারা অবরোধ আন্দোলনে মাতববরি করতে গিয়ে গণরোষের মুখে পড়েন৷ দূর্গাবাড়িস্থিত পেট্রোল পাম্পের সামনে উপস্থিত দ্বিচক্র যান চালকরা তাদের উত্তম মধ্যম দিতে এগিয়ে আসলে পুলিশ কোনক্রমে পরিস্থিতি সামাল দেন৷ অবস্থা বেগতিক দেখে সিট্যুর বাইক বাহিনী ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন৷ তবে, বড়দোয়ালীতে সিট্যুর দাদাগিরিতে পেট্রোল নিতে আসা দ্বিচক্র যান চালকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ লাল ঝান্ডা হাতে নিয়ে সিট্যুর কর্মকর্তারা বহু দ্বিচক্র যান চালকদের শাসিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে৷ বিকাল পাঁচটা নাগাদ সিট্যুর রক্তচক্ষুর মুখে পড়ে উপস্থিত অনেকেই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷ একদিকে সিট্যুর কর্মকর্তাদের গুন্ডামি চলছিল, অন্যদিকে পুলিশ সবকিছু দেখেও নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে উপস্থিত দ্বিচক্র যানচালকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়৷
এদিন সকালে, খাদ্যমন্ত্রীর কনভয় আটকে দিয়েছিল ক্ষুব্ধ যান চালকরা৷ পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রুট বদল করে তিনি গন্তব্যে পৌঁছেন৷ এদিকে, সকালেই মহাকরণের প্রবেশের মূল রাস্তায় অবরোধ আন্দোলন গড়ে তুলে তৃণমূলের যুব ব্রিগেড৷ এখানে তৃণমূলীরা বেশ কয়েকজন আমলার গাড়ি মহাকরণে যেতে দেয়নি৷ এনিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়৷ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন পশ্চিম জেলার পুলিশ সুপার, জেলা শাসক সহ পদস্থ আধিকারীকরা৷ পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়৷ অফিস টাইমের পর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে৷
এদিন, সবচেয়ে বেশী সময় ধরে অবরুদ্ধ ছিল লক্ষ্মীনারায়ন মন্দির সংলগ্ণ রাস্তাটি৷ সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে অবরোধ৷ এমনকি মূল রাস্তা থেকে কাসারি পট্টি যাওয়ার রাস্তাটিও বন্ধ করে দেয় অবরোধকারীরা৷ এই রাস্তায় একাধিকবার টায়ার পোড়ানো হয়৷ দিনের একটা সময় যখন রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বলছিল তখন সেই রাস্তা দিয়ে এলপিজি’র বুলেট ট্রাক অতিক্রম করছিল৷ যেকোন মুহুর্তে ভয়ানক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত৷
এদিকে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সন্ধ্যায় রাজধানী আগরতলা মাইক যোগে পেট্রোল সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের তরফে৷ পাশাপাশি যেকোন সময় পেট্রোলের দাবীতে পরিস্থিতির যাতে আরও অবনতি না হয় সেজন্য জেলা প্রশাসনের তরফে টিএসআর বাহিনী মোতায়েন করা হয় শহরজুড়ে৷ প্রতিটি পাম্পের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ১৪৪ ধারা জারী করার৷ কিন্তু, সদর মহকুমা শাসক সুমিত রায় চৌধুরী জানিয়েছেন আপাতত এই ধরনের পরিস্থিতি এখনও দেখা দেয়নি৷
তবে, রাজ্যে এই পেট্রোল বিদ্রোহের রাশ টানা কবে নাগাদ সম্ভব হবে সেই বিষয়ে রাজ্য সরকারের তরফে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু জানা যায়নি৷ রাজ্য সরকার অনুভব করতে পারছে যে, রাজ্যে পেট্রোল নিয়ে এক মারাত্মক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে রয়েছে৷ কিন্তু, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোন দিশা খঁুজে বের করতে ব্যর্থ রাজ্য সরকার৷ পেট্রোলের রেশনিং এবং জোড়-বিজোড় ফর্মুলা চালু করেও কোন কিছুতেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ বরং বৃহস্পতিবার পেট্রোল নিয়ে বিদ্রোহ রণংদেহী আকার ধারণ করে৷ একথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, একাংশ যান চালক কৃত্রিম সংকট তৈরী করেছেন৷ কিন্তু, এই কৃত্রিম সংকট থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে সেই বিষয়ে দায়িত্বশীল সরকারের ভূমিকায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলেই মনে করছেন আম জনতা৷
পেট্রোল সংকটের রাজ্য সরকার নিজেদের দায় স্বীকার করতে চাইছে না৷ বরং বরাবরের মতো কেন্দ্রের ঘারেই দোষ চাপাতে চাইছে রাজ্য সরকার৷ অবশ্য কেন্দ্রও এই সংকটজনক পরিস্থিতির জন্য নিজেদের দায় এড়াতে পারে না৷ এই বিষয়ে পূর্তমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী এবং পরিবহণমন্ত্রীর বক্তব্য কেন্দ্রীয় সরকারের চরম গাফিলতির কারণেই আসাম আগরতলা জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা কাটছে না৷ অবশ্য একথা একশ ভাগ সত্য, দেশের একটি প্রান্তে অবস্থিত রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের মনোভাব চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে৷ পূর্তমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুসারে দীর্ঘ ছয়মাস ধরে জাতীয় সড়কটি সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না৷ সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ণ উঠছে কেন্দ্রীয় সরকার ত্রিপুরার প্রতি ন্যুনতম গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে কি না৷ কারণ, দেশে যেখানে প্রযুক্তির ছয়লাপ, এর মাঝে জাতীয় সড়কের মাত্র দেড় কিলোমিটার অংশ সারাই করতে ছয় মাসের উপর সময় লেগে যাচ্ছে, সেই বিষয়টি কোন ভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না৷ আসামে নতুন বিজেপি সরকার সদ্য ক্ষমতায় এসে অল্প কিছু সময়ে দীর্ঘদিনের এই সমস্যাকে সমাধান সম্ভব নয় বলে আত্মসমর্পণ করলেও পূর্বতন সরকারের গাফিলতি চক্রান্ত বলেই মনে করা হচ্ছে৷
এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্তমন্ত্রী জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক মন্ত্রককে একাধিকবার জাতীয় সড়ক সংস্কারের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ রাজ্যের প্রতি দায়িত্বশীল হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক নিজ উদ্যোগে আসাম আগরতলা জাতীয় সড়কের মারাত্মক বিপর্য্যস্ত দেড় কিলোমিটার অংশটি সংস্কার করা উচিত ছিল৷ এদিন তিনি বলেন, জাতীয় সড়ক সংস্কারে আসাম সরকারের যতটা না অনিহা দেখা গিয়েছে ততটাই কেন্দ্রীয় সরকার উদাসীন বলে মনে করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে পেট্রোপণ্যের জন্য রাজ্যে যেভাবে হাহাকার লেগে গিয়েছে, সেই দিকে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল ত্রিপুরাবাসীর কথা চিন্তা করে নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যার সমাধান করার৷
পেট্রোপণ্যের সংকটের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়বদ্ধতার অভাব আরও বিশেষ ভাবে মনে করা হচ্ছে কারণ, রাজ্য সরকারের তরফে কেন্দ্রের কাছে মেঘালয়ের দাউকি দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে রাঘনা সীমান্ত দিয়ে ধর্মনগরে জ্বালানী তেল পৌঁছানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল৷ আইওসি কর্তৃপক্ষও এই ক্ষেত্রে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছিল৷ কিন্তু, এই প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ আদৌ নেবে কি না সেই প্রশ্ণই উঠতে শুরু করেছে৷ কারণ, এখন পর্যন্ত বিদেশ মন্ত্রক ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের তরফে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই সংক্রান্ত কোন প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে নিশ্চিত কোন খবর নেই৷ ফলে, জাতীয় সড়ক দিয়ে পেট্রোপণ্য আনতে সমস্যা দেখা দেওয়ায় বিকল্প রাস্তা খঁুজে বের করারও কোন তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷
এদিকে, খাদ্যমন্ত্রী এদিন জানিয়েছেন, রাজ্যে পেট্রোল ট্যাঙ্কার দ্রুততার সাথে আসতে পারছে না৷ যেখানে ৫৮টি ট্যাঙ্কারের চাহিদা রয়েছে, সেখানে তা পাওয়া যাচ্ছে না৷ স্বাভাবিক অবস্থায় রাজ্যের ৬২টি পাম্পে ১৭০টি ট্যাঙ্কার আসত৷ গড়ে প্রতিদিন ৫০-৫২টি ট্যাঙ্কার ঢুকত৷ রাজ্যে পেট্রোলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আইওসি-কে চাপ দিয়ে বাড়ানো হয়েছে ট্যাঙ্কারের সংখ্যা৷ আগের তুলনায় জ্বালানী তেলের ট্যাঙ্কারের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৩৯টি৷ কিন্তু, এখন স্বাভাবিকের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম ঢুকছে৷ ফলে, সমস্যা বেড়েছে৷ এদিকে, শুক্রবার রাতে বিশ্রামগঞ্জেও পেট্রোলের জন্য রাস্তা অবরোধ করেন যান চালকরা৷