নিজস্ব প্রতিনিধি, খোয়াই, ১৩ জুলাই ৷৷ বুধবার সকালে প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিতে খোয়াই পৌছলেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যরাও৷ প্রথমেই মুখ্যমন্ত্রী পৌছান খোয়াই ডাক বাংলোতে৷ মুখ্যমন্ত্রীর খোয়াই সফরকে কেন্দ্র করে বুধবার খোয়াই শহর ছিল সাজো সাজো রব৷ রাস্তা-ঘাট যেমন ঝকঝক করছিল, তেমনি বিদ্যুৎ পরিষেবা একবারের জন্যও বিঘ্নিত হয়নি৷ এমনকি পানীয় জল সরবরাহ হয় নিয়ম মেনে দিনে দু’বার৷ একইভাবে মুখ্যমন্ত্রীর খোয়াই সফরকে কেন্দ্র করে ট্রাফিক ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো৷ অথচ দীর্ঘদিন যাবত খোয়াইতে পানীয় জল, বিদ্যুৎ ও রাস্তা-ঘাটের সমস্যা নিয়ে নাজেহাল খোয়াইবাসী৷ তেমনি ট্রাফিক ব্যবস্থার ভঙুর অবস্থার মধ্যে নিত্যদিনই জনসাধারনকে ভোগান্তির স্বীকার হতে হয়৷ তবে বুধবার দিনটি ছিল ঝা-চকচকে৷ তাই খোয়াইবাসীর দাবি মুখ্যমন্ত্রী যেন বারবার খোয়াই সফর করেন৷ যদিও একই দিনে দু-দুটি পর্যালোচনা সভা করার পর খোয়াইয়ে পানীয় জল ও রাস্তা-ঘাটের দূরাবস্থা দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রীও৷
খোয়াই জেলার আইন শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক পর্যালোচনা সভায় খোয়াই জেলার সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি প্রতিটি থানায় মামলার পরিসংখ্যান এবং কি ধরনের মামলা হচ্ছে তারও খোঁজ খবর নেন মুখ্যমন্ত্রী৷ খোয়াই জেলায় অধিক মাত্রায় মহিলা সংক্রান্ত মামলার পরিসংখ্যান দেখে মুখ্যমন্ত্রী আশ্চর্য্য হেেঃয়ছন বলে জানা যায়৷ মহিলা সংক্রান্ত অপরাধ বৃদ্ধির কারন ও তার বিচার বিশ্লেষন করে এই ধরনের অপরাধ কমানোর কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ একই সাথে জেলার পুলিশের পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে এবং মুখ্যমন্ত্রী৷ সার্বিকভাবে মানুষকে প্রয়াসের মাধ্যমে সচেতন করে সামাজিক অপরাধ কমানোর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে পুলিশের ডিজিকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ এছাড়া জুয়ার রমরমা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের কথাও বলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ সভায় খোয়াই জেলার প্রতিটি থানার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হন মুখ্যমন্ত্রী৷ সীমান্ত সমস্যা ও অপরাধ যাতে না ঘটে তার প্রতি নজর দিতেও বলেন৷ অপরদিকে দিনের দ্বিতীয় পর্যালোচনা সভাটি হয় জেলার অন্যান্য দপ্তরগুলির উচ্চপদস্থ ও পদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে৷খোয়াই জেলায় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচী রূপায়ণের ফলে মানুষের জীবনমান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিলক্ষিত হলেও গত কয়েক বছরে মাধ্যমিক ও দ্বাদশের পরীক্ষায় ফলাফল তেমন আশানুরূপ হচ্ছেনা৷ এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ছেলেমেয়েদের সুকলে আনতে হবে এবং তাদের ক্লাশ রুম স্টাডির উপর বেশী করে গুরত্ব দিতে হবে৷ আজ বিকালে খোয়াই জেলা শাসকের কার্যালয়ে খোয়াই জেলা ভিত্তিক বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিকদের নিয়ে এক পর্যালোচনা সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ এই পর্যালোচনা সভায় শিক্ষা দপ্তরের আলোচনা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, শিক্ষকরা ঠিকমতো সুকলে যান কিনা ঠিকমতো পাঠদান করেন কিনা, তা নিয়মিত দেখা দরকার৷ তিনি বলেন, শিক্ষকদের সময়ে সুকলে আসতে হবে, প্রার্থনা সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকবে হবে৷ শিক্ষকদের নিজের লেসন নিজেকেই সম্পন্ন করতে হবে৷ পড়ানোর পর ছাত্র-ছাত্রীরা সেই বিষয়টি ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে কিনা তা-ও শিক্ষকদেরই এসেসমেন্ট করতে হবে৷ উল্লেখ্য, পর্যালোচনা সভায় বিদ্যালয় শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলার পাশের হার ৪৬৭৫ শতাংশ৷ ২০১৫ সালে ছিল ৫৮৫৪ শতাংশ৷ অন্যদিকে, ২০১৬ সালে উচ্চতর মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হাত ৬৯৬৯ শতাংশ, ২০১৫ সালে ছিল ৭৩৪৭ শতাংশ৷ দুটি পরীক্ষাতেই আগেরবারের চেয়ে এবছর পাশের হ ার কমে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং ষষ্ঠ থেকে অস্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার ভিত্তিটা ভালভাবে তৈরী করে দিতে পরামর্শ দেন৷ জেলার প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে নিদিষ্ট সময় পর পর পর্যালোচনা সভা করতে বলেন তিনি৷ এছাড়াও সুকলগুলোতে সারপ্রাইজি ভিজিট করতে নির্দেশ দেন৷ জিলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলির সভায় শিক্ষা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করতে বলেছেন তিনি৷
খোয়াই জেলার পর্যালোচনা সভায় মূলত সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুতায়ন, সেচ, পানীয় জল ও স্বাস্থ্য বিধি, হাউজিং প্রকল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি হর্টিকালচার, মৎস্য, প্রাণী সম্পদ, বন প্রভৃতি দপ্তরের বিভিন্ন কর্মসূচীর পর্যালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী৷ পূর্ত দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয় জেলায় ৯৯০ টি জনবসতির মধ্যে ৭৩৭ টি জনবসতিতে সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা হয়েছে৷ এছাড়া, ২২টি জনবসতিতে সড়ক যোগাযোগের কাজ চলছে৷ ৭১ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ বিদ্যুৎ দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১১৩৭টি ঞ্ঝজনবসতির মধ্যে ১০৭৯টি বসতিতে ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে৷ চলতি বছরে আরও ৩৫টি জনবসতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ ২০১৭-১৮-এর মধ্যেই সব অবিদ্যুতায়িত বসতিতে বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
জল সম্পদ দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, খোয়াই জেলায় মোট কৃষি জমির পরিমান ৪০১৭৯ হেক্টর৷ এর মধ্যে ইতিমধ্যেই দপ্তরের পক্ষ থেকে ১৬৪৭৬ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে৷ আরও ১৬৪৭ হেক্টর জমি সেচের আওতায় আনতে দপ্তরের পক্ষ থেকে আগামী দিন বছরের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যানও নেওয়া হয়েছে৷ ২০১৮-১৯ এর মধ্যে মোট কৃষি জমির ৬০ শতাংশ জমিকে সেচের আওতায় আনতে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরী করতে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন৷ পানীয় জল ও স্বাস্থ্য বিধি দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জেলার ১১৭৩টি বসতির মধ্যে সবগুলিতেই পানীয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে৷ কোন এন সি পাড়া নেই৷ এর মধ্যে ৬১১টি পাড়া রয়েছে পিসি৷ ২০১৮ এর মধ্যে এগুলিকে এফ সি করার জন্য দপ্তরের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷
জেলা শাসক জানান, ২০১৫-১৬ সালে ২৫৭৬টি বাসগৃহ তৈরী করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল৷ আগামী আগষ্ট মাসে এগুলির কাজ শেষ হবে৷ এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে ১৫১৮৩টি পরিবারকে শৌচাগার তৈরী করে দেওয়া হবে রেগার মাধ্যমে৷ তেলিয়ামুড়া ও খোয়াইয়ের শহরের রাস্তার পাশেই ব্লক হেড-কোয়ার্টারগুলিতে এবং গ্রামের বড় বড় বাজারগুলিতে পাবলিক টয়লেট তৈরী করে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র কিংবা হাসপাতালে একশ শতাংশ প্রসব সুনিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ এক্ষেত্রে আশাকর্মীদের বিশেষ ভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আশাকর্মীরা নিয়মিতভাবে বাড়ি বাড়ি গর্ভবতী মায়েদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন এবং প্রসবের জন্য তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসছেন৷
বনাধিকার আইনে পাট্টা প্রাপ্তদের জমিতে বিভিন্ন কৃষিজ ফলস উৎপাদন এবং ফল চাষের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে কৃষি ও হর্টিকালচার দপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ পাশাপাশি হটিকালচার দপ্তরকে ফল ও সব্জী চাষে আরও গুরুত্ব দিতে বলেছেন তিনি৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ফল সব্জী চাষের মাধ্যমে কৃষকদের অর্থনৈতিক উন্নতির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে৷ তিনি রেগার সাহায্য নিয়ে মাছ চাষের এলাকা আরও বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন মৎস্য দপ্তরকে৷ দুধের উৎপাদন বাড়াতে আরও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে প্রাণী সম্পদ বিকাশ দপ্তরকে বলেছেন তিনি৷ মানুষের উপার্জন বাড়াতে দুগ্দ উৎপাদন খুব উল্লেখযোগ্য বলে তিনি মন্তব্য করেন৷
সর্বত্র পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে মুখ্যমন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন৷ সব সরকারি কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে ও গাছ লাগাতে বলেছেন তিনি৷ জাতীয় সড়ক সহ সব রাস্তার দু’পাশেও পরিস্কার রাখতে ও গাছ লাগাতে বলেছেন৷ জিলা পরিষদ ও পুর পরিষদের সভাগুলিতে এবিষয়ে পর্যালোচনা করতে পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷
খোয়াই জেলার পর্যালোচনা সভায় মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রিসভার সদস্য অঘোর দেববর্মা ও খগেন্দ্র জমাতিয়া, খোয়াই জিলা পরিষদের সবাধিপতি সাইনি সরকার, মুখ্যসচিব যশপাল সিং, প্রদান সচিব এম নাগারাজু, জেলা শাসক অপূর্ব রায়, জেলার সব মহকুমা শাসক ও বি ডি ও গণ এবং বিভিন্ন দপ্তরের আধিকারিকগণ উপস্থিত ছিলেন৷