৷৷ নিখিল চন্দ্র ভদ্র৷৷ ঢাকা, ২ জুলাই ঃ রাজধানী ঢাকার গুলশানে বন্দি করে এক ভারতীয় তরুণী সহ ১৭ বিদেশী নাগরিক এবং তিন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে আইএস জঙ্গিরা৷ বন্দিদের উদ্ধার অভিযান চলাকালে জঙ্গিরা দুই পুলিশ কর্তাকেও গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করেছে৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানিয়েছে বন্দীদের নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে জঙ্গিরা৷ নিহতদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত পাওয়া গেছে৷
সম্প্রতি ব্লগার, শিক্ষক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্নভাবে হত্যার ঘটনা ঘটলেও বিদেশীদের বন্দি করে আইএস জঙ্গিদের এ ধরনের হামলার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম৷ শুক্রবার রাত ৯টা থেকে শনিবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি নামে ক্যাফেতে প্রায় ১২ ঘন্টার এই বন্দিদশার অবসান ঘটে৷ সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে ৬ বন্দুকধারী নিহত হলেও তার আগে ২০ বন্দিকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে শনিবার দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে৷ অস্ত্রধারী জঙ্গিদের হামলায় ভারতীয় তরুণী তারুশী নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনির্ভিার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার (বার্কলে) পড়ুয়া তারুশির বাবার নাম জিয়ান সঞ্জিব৷ তারুশি বারিধারার একটি বাড়িতে থাকতেন৷ তিনি শুক্রবার রাতে ওই রেস্তোরায় আটকা পড়েছিলেন৷ ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক ট্যুইট বার্তাতেও তারুশির মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন৷
এদিন ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, বন্দীদের উদ্ধারে শনিবার অভিযান শেষে ওই রেস্তোরার ভেতরে ২০টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে৷ তিনি এই ২০ জনের পরিচয় জানাতে পারেননি৷ তবে নিহতদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশী এবং ৩ জন বাংলাদেশী বলে জানানো হয়েছে৷
এই ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মোট ২৮ জনে দাঁড়িয়েছে৷ এদের মধ্যে গতরাতে অভিযানের সময় বনানী থানার ওসি ও ডিবি’র একজন কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান৷ আর কমান্ডো অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শনিবার সকালে নিহত হন ৬ জন বন্দুকধারী৷ এ সময় এক বন্দুকধারীকে জীবিত আটক করা হয়৷ সেনা কর্তা জানান, জঙ্গীদের কাছ থেকে চারটি পিস্তল, একটি ফোল্ডেট বাট একে-২২ রাইফেল, চারটি তাজা আইইডি এবং প্রচুর ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে৷
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, শুক্রবার রাতে হলি আর্টিজানে বন্দুকধারীদের হামলার পরপরই ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে৷ এসময় বন্দুকধারীদের হামলায় বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ডিবি’র এসি রবিউল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন৷ পরে সরকার প্রধানের নির্দেশে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের নেতৃত্বে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ শীর্ষক কমান্ডো অভিযান পরিচালিত হয়৷ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযান শুরু হয়৷ এর আগে ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সাত বন্দুকধারীর মধ্যে ছয়জন নিহত হয়৷ সকাল সাড়ে ৮টায় অভিযান সম্পন্ন হয়৷ তিনি জানান, অভিযানকালে একজন জাপানি ও দু’জন শ্রীলঙ্কান সহ ১৩ জন বন্দিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়৷
মৃতদেহ ঢাকা সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল সিএমএইচে রাখা হয়েছে৷ ময়নাতদন্তের পর এসম মৃতদেহ স্বজনদের হস্তান্তর করা হবে৷ এজন সেনাবাহিনীর প্রভোস্ট মার্শালের সঙ্গে তার মোবাইল ফোন নম্বরে (০১৭৬৯০১২৫২৪) যোগাযোগ করতে বলেছে আইএসপিআর৷
শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বরের আর্টিজান রেস্তোরায় ৭ থেকে ১০ জন যুবক গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢুকে পড়ে৷ এরপর তারা ওই রেস্তোরায় থাকা লোকজনকে বন্দি করে৷ জঙ্গি হামলার কিছুক্ষন পর পুলিশের অগ্রগামী দলের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমায় নিহত হন৷ আহত হন অন্তত ৪০ জন পুলিশ সদস্য৷ জঙ্গি হামলা চালিয়ে দেশী-বিদেশী নাগরিকদের বন্দি করার ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট(আইএস)৷ একই সঙ্গে তাদের দাবি, এ হামলায় তারা ২৪ জনকে হত্যা করেছে৷
এদিকে, বন্দিদের মধ্যে থাকা তিন বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর দিয়েছে তাদের পরিবার৷ তাঁরা হলেন, ফারাজ হোসেন, ইশরাত আখন্দ এবং অবিন্তা কবীর৷ তিনজনই ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান এবং হোটেলে খাওয়ার জন্য গিয়েছিলেন৷ এছাড়া মৃতদের মধ্যে ইতালির সাত জন ও জাপানের সাত নাগরিক বলে ধারনা করা হচ্ছে৷ বাকি দুই জন কোন দেশের তা এখনো জানা যায়নি৷
আন্তর্জাতিক এই জঙ্গিগোষ্ঠির বাংলাদেশে তৎপরতার খবর সরকার বার বার নাকচ করে এলেও এই ঘটনাটিকে ‘জঙ্গি হামলা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাহসিনা৷ শনিবার সকালে এক অনুষ্ঠানে তিনি হামলাকারী জঙ্গিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘যখন এশার আযান হয়েছে, সে যাােব নামাজ পড়তে৷ আযান উপেক্ষা করে সে গেল মানুষ খুন করতে৷ সে কেমন মুসলমান৷ এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গুলশানের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে দুই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীই সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷
এদিকে, বাংলাদেশে এই হামলার জের ভারতেও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলিতে হাই এলার্ট জারি করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক৷ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যগুলিকে বিমান বন্দরে নজরদারী বাড়ানো হয়েছে৷ তার সাথে তল্লাশিও করা হচ্ছে৷