নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৪ মে৷৷ শিক্ষার অধিকার সারা দেশেই ভূলুন্ঠিত৷ শিক্ষার অধিকার আইন নিয়ে জোর দাবী

উঠলেও বাস্তব পরিস্থিতি উদ্বেগের সেটাই ফুটে উঠল আজ প্রজ্ঞা ভবনে শিক্ষার অধিকার, সিভিক সার্ভিসেস এবং মানবাধিকার নিয়ে সেমিনারে বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে৷ দেশের বুনিয়াদি শিক্ষাই কার্যত বিপর্যস্ত৷ কিন্তু, আওয়াজ উঠেছে আধুনিক ভারত রচনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন রকম আপোষ করা চলবে না৷ শিক্ষাই যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার, সেখানে শিক্ষা ক্ষেত্রে আপোষ করা মানেই হল মানবাধিকার উলঙ্ঘন করা৷ সেমিনারে বক্তাদের মতে বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত নড়বরে হলে আধুনিক ভারত রচনা করা কোনওমতেই সম্ভব নয়৷ সেই ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুনমানে কোনওভাবেই ঘাটতি থাকলে চলবে না৷
এদিন এই সেমিনারে গোটা দেশে শিক্ষার বেহাল চিত্র ফুটে উঠেছে৷ শিক্ষার অধিকার আইন নিয়ে দেশজুড়ে ঝড় উঠলেও বাস্তব চিত্র তার ভিন্ন রূপ বর্ণনা করছে৷ রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের সচিব জগদিশ সিং কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এক রিপোর্টের উদ্বৃতি করে বলেন, গোটা দেশে ৯ লক্ষ ৭ হাজার ৯৫১টি শিক্ষকের শূন্যপদ রয়েছে৷ বুনিয়াদি শিক্ষায় গোটা দেশের ১ঃ৩০ অনুপাতে শিক্ষক রয়েছে৷ শতাংশের মোট অনুপাত ৪৫৷ উদ্বেগের বিষয় হল এদের মধ্যে ২৫ শতাংশ শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ণ রয়েছে৷ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাও গোটা দেশের মতোই করুন৷ উচ্চ শিক্ষা দপ্তরের সচিব জানিয়েছেন, প্রত্যন্ত এলাকায় আনুমানিক ১ঃ২৯ অনুপাতে শিক্ষক রয়েছেন সুকলগুলিতে৷ পশ্চিম ত্রিপুরায় অবশ্য ১ঃ১৬ অনুপাতে শিক্ষক আছেন৷ তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, রাজ্যের সুকলগুলিতে ড্রপ আউটের সংখ্যা প্রায় ১৮১৮ জন৷ তবে, তাঁর বক্তব্যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এক বিরাট প্রশ্ণ উঠেছে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে৷ তিনি বলেন, রাজ্যের অধিকাংশ শিক্ষকের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে৷ সুকলগুলির প্রতি ছাত্রছাত্রীদের ঝোঁক বাড়ালেই চলবে না, সঠিক ও গুনগত শিক্ষা প্রদান করা না গেলে শিক্ষার অধিকার বাস্তবে জলাঞ্জলি ঘটবে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সচিবের বক্তব্যে এমনটাই ফুটে উঠেছে৷
এদিকে, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্য আর পি মীনাও শিক্ষা ব্যবস্থার চরম দুর্দশা নিয়ে সূর চড়িয়েছেন৷ তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, গুনগত শিক্ষা আজ গোটা দেশে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অভিভাবকদের একাংশ যাদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তাঁরা সরকারী সুকলগুলির বদলে বেসরকারী সুকলের দিকে ঝোঁকছেন৷ তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, সরকারী সুকলগুলিতে গুনগত শিক্ষার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে৷ এর জন্য তিনি শিক্ষক কূলকেই দায়ী করেছেন৷ সুকলগুলিতে সঠিক শিক্ষার ঘাটতির কারনেই ছাত্রছাত্রীরা গুনগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ তিনি অভিযোগ করে বলেন, এমন বহু সুকল রয়েছে যেখানে শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের দিকে সঠিকভাবে মনযোগ দিচ্ছেন না৷ গ্রামীণ এলাকায় বহু শিক্ষক যেতে চান না৷ তাদের বদলে প্রক্সি টিচার দিয়ে সুকলের পঠন পাঠন চলে৷ তিনি জানান, এই প্রক্সি টিচারদের অধিকাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম মান উত্তীর্ণ৷ সুকলস্তরে শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন নিয়েও তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন৷ সুকলগুলিতে পঠন পাঠনে ঘাটতির পেছনে প্রাইভেট টিউশনকেও তিনি অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ শ্রীমীনা বিরক্তির সূরে বলেন, সুকল স্তরে বহু শিক্ষক রয়েছেন যাঁরা সুকলে ঠিকমতো পড়ান না৷ তার বদলে তাঁরা প্রাইভেট টিউশনে মগ্ণ৷ এই ধারা বদলানোর পক্ষে সওয়াল করে তিনি বলেন, সুকলগুলিতে গুনগত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে সক্ষম হলেই ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে৷
শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল চিত্র নিয়ে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের সচিব এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্য যেভাবে সূর চড়িয়েছেন তার সাথে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে জাস্টিস কল্যাণজ্যোতি সেনগুপ্ত বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্যান ধারনা পাল্টেছে কিন্তু প্রয়োজন পাল্টায়নি৷ তিনি স্পষ্ট বলেন, শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোন অস্তিত্বই নেই৷ মানুষের জীবন ধারনের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষা৷ তাই শিক্ষা শুধু মৌলিক অধিকারই নয়, এটা জীবনেরও অধিকার৷ আর সঠিক শিক্ষা প্রদানের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে শিক্ষকদেরই৷ তিনি স্পষ্ট বলেন, ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষা এমনভাবে পৌঁছে দিতে হবে যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে৷ এদিন, তিনি অনেকটা ক্ষোভের সাথেই বলেন, বর্তমান সময়ে শিক্ষা খুবই ব্যয়বহুল হয়ে গিয়েছে৷ ন্যুনতম প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদেরও প্রাইভেট টিউশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে৷ তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যা আজ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে৷ যাদের অর্থ আছে তাদের সন্তানরা গুনগত শিক্ষার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে তিনি পরোক্ষে শিক্ষার অধিকারের চরম অবমাননা হচ্ছে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ শিক্ষা ব্যবস্থার করুন চিত্র পাল্টাতে তিনি শিক্ষকদের এগিয়ে আসার এবং নিজেদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে আহ্বান জানিয়েছেন৷ তিনি স্পষ্ট বলেন, ছাত্রছাত্রীদের মনে কৌতুহল জাগাতে হবে, তাদের স্বপ্ণ দেখাতে হবে৷ দেশাত্মবোধে জাগ্রত করতে হবে৷ এই সবের মধ্য দিয়েই শিক্ষক সমাজ পারেন একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে৷ শিক্ষকদের এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতেই হবে৷ এদিকে, তিনি সিভিক সার্ভিসের অধিকার প্রসঙ্গে বলেন, নিরাপদ পানীয় জলের অধিকারও মৌলিক অধিকার৷
এদিকে, এদিনের সেমিনারে স্বাগত ভাষণ দেন রাজ্যের আইন সচিব এ কে নাথ৷ তাছাড়াও সেমিনারে বক্তব্য রাখেন ত্রিপুরা মানবাধিকার কমিশনের অপর সদস্য সমীরণ দাস৷ সেমিনারে কলকাতা থেকে আগত বিশিষ্ট আইন গবেষক সোহিনী ব্যানার্জি বলেন, কোন সামাজিক আন্দোলনই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে পারেনা মানবাধিকারকে বাদ দিয়ে৷ শিক্ষার অধিকারের বিষয়টি এখন মানবাধিকারে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই৷

