লেনিনের জন্মদিনের ভাষণে বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন মানিক সরকার

LENIN CM৷৷ দেবাশীষ ঠাকুর ৷৷
সেই সত্তরের দশকে ত্রিপুরা শুধু নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ ছিল অগ্ণিগর্ভ৷ ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’ দেয়ালে দেয়ালে লেখা এই শ্লোগান এখন অতীতের গর্ভে৷ সেই নকশাল পন্থীরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন সশস্ত্র বিপ্লব ছাড়া ক্ষমতা দখল করা যায় না৷ আর এই বিশ্বাসে ভর করে শত শত যুবক আত্মাহুতি দিয়েছিলেন৷ ১৯৬২ সালে চীন ভারত যুদ্ধের পরই ত্রিধা বিভক্ত হয় কমিউনিস্ট পার্টি৷ রাশিয়াপন্থী ভারতের মূল কমিউনিষ্ট পার্টি সিপিআই এখন তলিয়ে গিয়েছে৷ একসময় সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব এবং সিপিআই-কংগ্রেস ভাই ভাই অবস্থার পরিণতি কি তাতো দেশবাসী দেখতেই পেলেন৷ সিপিআই যেমন প্রায় হারিয়ে গেল ঠিক তেমনি দপাস করে নিভে গেল সিপিআই(এমএল) দলটি৷ বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে চারিদিকে যেভাবে বুর্জোয়া নিধন শুরু হয়েছিল, সেই আগুন যে একদিন নিভে যাবে তা কয়জন ভেবেছিলেন? তবে, বোমাবাজি, মানুষ মারা, বুর্জোয়ার সম্পদ লুট করা, বুর্জোয়া সুকল, বইপত্তর পোড়ানোর বিপ্লবকে তো কমিউনিষ্ট চীন সেদিন প্রকারান্তরে সমর্থন যুগিয়েছিল৷ পিকিং রেডিওতে ‘এইসব বিপ্লবের’ সংবাদ খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পুলিশ কাতারে কাতারে এইসব বিপ্লবীদের হত্যা করেছে৷ ত্রিপুরায় কমিউনিষ্ট মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর পুলিশ উত্তর ত্রিপুরায় হুরুয়ায় সাত নিরস্ত্র কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের হত্যা করেছে৷ আর এই নিধন যজ্ঞে যে পুলিশ সুপার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই টি কে সান্যালকে বাম সরকার পুরসৃকত করেছিলেন৷
‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ দেয়ালে দেয়ালে এই শ্লোগান আঁকা থাকত৷ এই ভাবেই এই বিপ্লব একদিন খতম হয়ে গেল৷ ময়দানে রয়ে গেল সিপিআই মার্কসবাদী সংক্ষেপে সিপিএম৷ এই দল বিশ্বাস করল সশস্ত্র বিপ্লব এই ভারতের মাটিতে অসম্ভব৷ এই সিপিএম স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেই বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বে উঠে এল৷ চীন বা রাশিয়া কোনও দেশের লেজুর বৃত্তিতে না গিয়ে দেশবাসীর মনে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরীতে অনেকটাই সফল হয়েছিল৷ তবে, চীনের প্রতি একটা টান বা আকর্ষণ অনুভব সিপিএম দলের আছে তা টের পাওয়া যেত৷ যে কমিউনিষ্টদের বুর্জোয়া সংসৃকতির উপর প্রবল আপত্তি, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস নেই, সেইখানে, তাঁরা ভারতের সংবিধানের প্রতি প্রবল আস্থা ব্যক্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ফর্মূলায় বিশ্বাসী হয়ে উঠল৷ একথা সত্যি যে, সারা দেশে সিপিএম দলের অস্তিত্বই খঁুজে পাওয়া মুশকিল৷ এই দলের বিস্তার ঘটছে না৷ বরং পশ্চিমবঙ্গের দূর্গ তছনছ হয়েছে৷ ক্ষমতা ফিরে পেতে ‘চিরশত্রু’ কংগ্রেসকে বন্ধু করা হল৷ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধবাবু, সূর্যবাবুরা ভোট চাইছেন৷ কী নিদারুন পরিস্থিতি৷ এই অবস্থায়, সিপিএম দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটি পলিটব্যুরোর সদস্য তথা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তো সত্যি কথাই বলেছেন৷ একথা তো অনেক বেশী সত্যি যে, লেনিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মানিকবাবু একেবারে সত্যি কথাই তুলে ধরেছেন৷ এর মধ্যে মারাত্মক অন্যায় কি হয়েছে সেটাই পরিস্কার হচ্ছে না৷
সারা দেশে সিপিএমের একেবারে বাস্তব চিত্র, মানিকবাবু একটি উপমা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন দলের নেতা কর্মীদের৷ তিনি বলেছেন, কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যাচ্ছেন আবার সময়ে সময়ে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যাচ্ছেন৷ কোথাও তো সিপিএম দলে আসছেন না৷ এই অবস্থায় সিপিএম দল সারা দেশে জায়গা করে নেবে কিভাবে? এই আক্ষেপ একজন বরিষ্ট কমিউনিষ্ট নেতার করার মধ্যে অন্যায় বা গেল গেল রব হওয়ার কোনও যুক্তি আছে মনে হয় না৷ তাঁর বক্তব্যে তিনি যদি ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’ শব্দটা ব্যবহার না করতেন তাহলে এত হৈচৈ হবার মতো ঘটনা হত না৷ কিন্তু তাঁর বক্তব্যের ভাবার্থ তো একশভাগ বাস্তব, সত্যি৷ একজন প্রবীণ কমিউনিষ্ট নেতার এই বাস্তব উপলব্ধি হওয়ার মধ্যে তো কোনও অন্যায় নেই৷ সেই উপলব্ধিই তিনি আমাদের চলতি ভাষার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন৷ সিপিএম দলকে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা বলার জন্য যে চিৎকার চলছে সে সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দল নীরবতাই পালন করছেন৷ আসলে, সিপিআই(এম) দল কোন অবস্থায় আছে সে বিষয়টিই উঠে এসেছে৷
ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের ইতিহাসে নানা ঘাত প্রতিঘাতের বিচিত্র দিক রয়েছে৷ সশস্ত্র বিপ্লবের পথ ছেড়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ গ্রহণের দীর্ঘ ইতিহাসে সিপিএম দল দেশব্যাপী গণভিত্তি গড়ে তুলতে পারল না৷ এই দুঃখ বেদনা কি কম? সেই কথাই তো ফুটে উঠেছে প্রবীণ নেতা মানিক বাবুর কন্ঠে৷ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা কথাটা কত প্রাসঙ্গিক তা কমিউনিষ্ট আন্দোলনের দীর্ঘ ধারাবাহিকতাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিয়েছে৷