নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩০ মার্চ৷৷ নিজেদের চালেই হোঁচট খেল প্রদেশ কংগ্রেস৷ ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বিরোধী দলনেতা সুদীপ রায় বর্মন প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা খুনে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে দায়ী করার তিনদিনের মাথায় ভোল বদল করলেন বীরজিৎবাবুরা৷ বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে জানালেন, বিমল সিনহার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী৷ শুধু তাই নয়, ঘটনা সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে নিজেদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করারও চেষ্টা করেছেন৷ তাতে বিমল সিনহা খুনের দায় এবং প্রচার থেকে স্বস্তি পেলেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ সেই সাথে ফুটে উঠেছে, রাজ্যে কংগ্রেস কতটা অনৈক্য, গোষ্টি দ্বন্ধের ভিতের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ এই সাংবাদিক সম্মেলনে সিবিআই তদন্তের দাবীতে ১৮ এপ্রিল ২৪ ঘন্টার ত্রিপুরা বন্ধ ডেকে বীরজিৎবাবুরা আরেক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন৷
এদিন, সাংবাদিক সম্মেলনে বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের সাথে অমিলের প্রশ্ণে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক বীরজিৎ সিনহা, বিধায়ক গোপাল রায় প্রমুখরা চরম অস্বস্তির মুখে পড়েন৷ নানা ভাবে যুক্তি তর্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেও ল্যাজেগোবরে হন৷ একদিকে তাঁরা বলেন, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা নিজেই তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী৷ আবার বলেন, বিরোধী দলনেতার মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করাকেও সমর্থন করছেন৷ ফলে, এদিন নিজেদের কথার জালেই জড়িয়ে পড়েন বীরজিৎ বাবুরা৷ এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে বীরজিৎ সিনহা, গোপাল রায় ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী পীযুষ বিশ্বাস৷ এদিকে আজ সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সিপিএম কটাক্ষের সুরে বলেন, কংগ্রেস বিধায়করা নিজেদের মধ্যেই গুলিয়ে যাচ্ছেন৷ তিনদিন আগে বিরোধীদলনেতা মুখ্যমন্ত্রীকে জড়িয়ে একরকম অভিযোগ আনেন৷ আজ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অন্য অভিযোগ তুলেছেন৷ তাঁদের নিজেদের মধ্যেই অমিল রয়েছে, ফলে বরাবরের মতো এবারও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টায় মেতে উঠেছে৷
গত ২৮ মার্চ বিধানসভা অধিবেশনে প্রয়াত স্বাস্থ্য মন্ত্রী বিমল সিনহা হত্যা সংক্রান্ত ঘটনার ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনার জন্য মুলতুবি প্রস্তাব আনার পর তা খারিজ করে দিয়েছিলেন অধ্যক্ষ রমেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ৷ পরিবর্তে স্বল্পকালীন আলোচনার জন্য সম্মতি জানিয়েছিলেন৷ কিন্তু বিরোধীরা ঐদিনই আলোচনার জন্য চাপ সৃষ্টি করে বিধানসভায় তুমুল হৈহট্টগোল করেন৷ বিরোধীদের হৈ হট্টগোলের মাঝে দুইবার অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করেন অধ্যক্ষ৷ পরে লবিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিনহাকে পাশে বসিয়ে বিরোধী দলনেতা সুদীপ রায় বর্মন দীপ্তকন্ঠে দাবি করেন, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা হত্যার সাথে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদত রয়েছে৷ এমনকি বিমল সিনহা মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল দাবিদার ছিলেন, সেজন্যও হয়ত তাঁকে খুন হতে হয়েছে এনিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন৷ ফলে, তিনি সেদিন দাবি করেছিলেন সঠিক তদন্ত হলে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে৷ তার জন্য তিনি সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন৷
অথচ আজ সাংবাদিক সম্মেলনে সেদিনের বিরোধী দলনেতার সমস্ত দাবী একপ্রকার নস্যাৎ করে দিয়ে বীরজিৎবাবুদের মতে, প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা নিজেই তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী৷ তবে, এর সিবিআই তদন্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে এই দাবীতে সোচ্চার হন৷ পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের পদত্যাগের দাবী জানান৷ কিন্তু এই হত্যা মামলায় সিবিআই তদন্তের আসলে প্রয়োজনীয়তা কোথায় তা খোলসা করে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি৷ কারণ, বিমল সিনহার হত্যার পেছনে ষড়যন্ত্রকারীকে খুঁজে বের করার জন্য, নাকি কেন তিনি খুন হয়েছেন সেই প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য সিবিআই তদন্ত চাইছেন তা স্পষ্ট করে না বলায় এই দাবীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ণ উঠতে শুরু করেছে৷ এনিয়ে এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআইএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশের স্পষ্ট বক্তব্য, এখন সিবিআই তদন্ত দেওয়া মানে কমিশনের তদন্তকে অবজ্ঞা করা৷ কংগ্রেসের বিচার বিভাগের উপর কোন আস্থা নেই বলে তিনি কটাক্ষ করেন৷
বুধবার কংগ্রেস ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট এবং রাজ্য সরকারের এ্যকশন টেকেন রিপোর্ট নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন প্রদেশ কংগ্রেসের লিগ্যাল সেলের চেয়ারম্যান আইনজীবি পিযুষ কান্তি বিশ্বাস৷ তাতে তিনি বার বার একটা বিষয়ই তুলে ধরেন, যে কমিশনের রিপোর্ট মোতাবেক প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার সাথে উগ্রপন্থীদের যোগাযোগ ছিল, সেই দায় মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার কিছুতেই এড়াতে পারেন না৷ পাশাপাশি বিমল সিনহা হত্যা মামলায় আদালতে অভিযুক্তদের বয়ানের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, সুখরঞ্জন সিনহা, রঞ্জিত দেববর্মাদের বয়ানে স্পষ্ট বিমল সিনহার সাথে বৈরীদের যোগাযোগ ছিল৷ এমনকি, ভাই অপহরণের পর অতি আত্মবিশ্বাসই বিমল সিনহাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে শ্রীবিশ্বাস দাবি করেন৷ তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, ভাইকে ছাড়াতে বিমল সিনহা নিরপত্তারক্ষী ছাড়াই উগ্রপন্থীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন৷ প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসী ছিলেন উগ্রপন্থীরা তাঁকে কিছু করবে না৷ এমনকি তিনি দুটি ওয়াকিটকিও নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে নদীর ওপারে উগ্রপন্থীদের সাথে কথা বলতে পারেন৷ কিন্তু উগ্রপন্থিরা তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে খুন করে সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ এদিন শ্রীবিশ্বাস এও দাবি করেন, রাজ্য সরকারের তরফে যে এ্যকশন টেকেন রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে তাতে পুলিশ কোথাও ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টকে খন্ডন করেনি৷
এদিকে, সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিএম সমস্ত অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছে৷ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদাশ বলেন, রাজ্যে সিপিএম নয়, কংগ্রেসই উগ্রপন্থীদের সৃষ্টিকর্তা৷ ১৯৮৮ সালে টিএনভি নেতা বিজয় রাঙ্খলের সাথে কংগ্রেসের গোপন সমঝোতায় ৮১ জন নীরিহ মানুষকে খুন করে রাজ্যের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে৷ তখন সেনা বাহিনী নামিয়ে জোট সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় কংগ্রেস৷ কংগ্রেস-টিইউজেএস জঙ্গলের রাজত্ব কায়েম করেছিল৷ এদিন শ্রীদাশ স্পষ্ট জানিয়েছেন, ইউসুফ কমিশনের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বিরোধীদের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রশ্ণই আসে না৷ এর সাথে আগামী ১৮ এপ্রিল সারা রাজ্যে কংগ্রেসের ডাকা ২৪ ঘন্টার বন্ধের তীব্র বিরোধীতা করে বলেন, রাজ্যবাসী এই বন্ধ প্রত্যাখান করবে৷
তবে, বিমল সিনহা হত্যা মামলা নিয়ে বিরোধী বিধায়করা নিজেদের বক্তব্যেই গড়মিল পাকিয়ে ফেলায় রাজ্যে ফের কংগ্রেসের কফিনে আরো একটি পেরেক পোঁতা হয়ে গেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল৷ স্বদলীয় বক্তব্যে মতভেদের জের আগামী দিনে বিরোধী আন্দোলন যে আরো চুপসে যাবে তা একপ্রকার নিশ্চিত৷