নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা/ উদয়পুর/ সাব্রুম/ শান্তিরবাজার, ১ মার্চ৷৷ গত প্রায় ৪৮ ঘণ্টায় রাজ্যের ৭টি জনজাতি সম্প্রদায়ের জনগণ এবং প্রধান সমাজপতিদের সঙ্গে মিলিত হন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব৷ তিনি বলেন,আমি অত্যন্ত খুশি যে, তাঁরা প্রত্যেকেই যার যার সমাজের উন্নয়নের জন্য ভাবছেন৷ আমি গর্বিত যে রাজ্যের ক্ষত্রীয়, চাকমা, ত্রিপুরী, মগ, রিয়াং, জমাতিয়া ও মলসুম সমাজের সমাজ পতিদের আমি নিজ হাতে সম্মানিত করার সুযোগ পেয়েছি৷ তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের এই প্রাপ্য সম্মান তাঁদের দেওয়া হয়নি৷ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্যও রাজ্যের জাতি-জনজাতি সবাইকে নিয়ে উন্নত ত্রিপুরা গড়ার স্বপ্ণ দেখেছিলেন যা আজ সার্থক হতে চলছে৷ আর দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস-এর মন্ত্র নিয়ে দেশকে পরিচালিত করছেন এবং সেই ধরাতেই রাজ্য সরকারও কাজ করে যাচ্ছে৷
জনজাতিদের সমাজজীবনে সমাজপতিদের মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে৷ জনজাতিদের ক’ষ্টি ও সংস্ক’তিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রত্যেক জনজাতি গোষ্ঠীর সমাজপতিগণ অগ্রণী ভূমিকা নেন৷ সমাজপতিরাই জনজাতিদের সমাজের ধারক ও বাহক৷ আজ কিল্লা ব্লকের জয়িংকামী মাঠে জমাতিয়া ও মলসম সম্পদায়ের সমাজপতিদের সম্মাননা প্রদান সমারোহ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন৷ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জনজাতি সমাজে সমাজপতিদের এই অবদানকে বিগত বছরগুলিতে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ বর্তমান সরকার সমাজপতিদের স্বীক’তি দানের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নিয়েছে৷ এদিকে লক্ষ্য রেখেই সরকার জনজাতি গোষ্ঠীর সমাজপতিদের সম্মাননা প্রদান করছে৷
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান রাজ্য সরকার এডিসি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয় করে ৬৮টি রাস্তা তৈরি করবে৷ এডিসি এলাকার সবগুলি রাস্তাকে পাকা করা হবে৷ এরমধ্যে ৩১টি রাস্তা তৈরি করতে ব্যয় হবে ১৩৫ কোটি টাকা৷ ৮টি রাস্তা তৈরিতে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি টাকা এবং ২৯টি রাস্তা তৈরি করতে খরচ হবে ১৮১ কোটি টাকা৷ তিনি বলেন, এডিসি এলাকায় পেপার ব্লকের রাস্তা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার৷ এরজন্য সরকার ৯৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে৷
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির ভাষণে ক’ষিমন্ত্রী প্রণজিৎ সিংহরায় বলেন, আজ এক ঐতিহাসিক দিন৷ রাজ্যে প্রক’ত যাদের সম্মাননা পাওয়ার অধিকার রয়েছে আজ সেই সমাজপতিদের এই অনুষ্ঠানে সম্মাননা ’াপন করা হলো৷ রাজ্যের জনজাতি গোষ্ঠীর ক’ষ্টি ও সংস্ক’তিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক৷ সরকার প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর ক’ষ্টি সংস্ক’তিকে সম্মান করে৷ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন গোমতী জিলা পরিষদের সভাধিপতি স্বপন অধিকারী, বিধায়ক বিপ্লব কুমার ঘোষ, জমাতিয়া হদার অক্রা পুলিন্দ্র কুমার জমাতিয়া, জমাতিয়া হদার অক্রা পদ্মলীলা জমাতিয়া, মলসম দফার রাই মদন হরি মলসম প্রমুখ৷ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিধায়ক রামপদ জমাতিয়া৷ অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ রাখেন গোমতী জেলার জেলাশাসক ড. টি কে দেবনাথ৷ আজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমাতিয়া হদার অক্রা পুলিন্দ্র কুমার জমাতিয়া, পদ্মলীলা জমাতিয়া এবং মলসম দফার রাই মদন হরি মলসমকে সম্মাননা জানান মুখ্যমন্ত্রী৷ এছাড়া অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পূর্বে কিল্লা ক’ষি মহকুমার অধীন ৬০ জন ক’ষককে জয়িংকামী মাঠে ভর্তকিতে ক’ষিজ যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়৷ এতে মোট ব্যয় হয় ২৪ লক্ষ ৬২ হাজার ৮১৪ টাকা৷
জনজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের দিশায় বর্তমান সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে৷ রাজ্যের ১৯টি জনজাতি গোষ্ঠীর ভাষা, শিক্ষা, সংস্ক’তির বিকাশে ও আর্থসামাজিক মানোন্নয়নে সরকার অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে৷ আজ সাবম মহকুমার মনুবনকুলে ধম্মদীপা সুকল মাঠে মগ জনজাতি গোষ্ঠীর প্রধান সমাজপতি সুুচলা মগের সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এই কথা বলেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব মগ জনজাতি গোষ্ঠীর প্রধান সমাজপতি সুুচলা মগের হাতে মারক ও শংসাপত্র তুলে দেন৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব অনুষ্ঠানে বলেন, ত্রিপুরা সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রথম ত্রিপুরার জনজাতি গোষ্ঠীর সমাজপতিদের সম্মান জানানো হচ্ছে৷ কোনও জাতিগোষ্ঠীর সমাজপতিকে সম্মান জানানো হলে সেই জনগোষ্ঠীর মানুষ সম্মানিত বোধ করেন, তাদের আত্মমর্যাদাও বৃদ্ধি পায়৷ তিনি বলেন, ত্রিপুরার ১৯টি জনজাতি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা ভাষা ও সংস্ক’তি রয়েছে৷ কিন্তু ভাষা সংস্ক’তি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকলের মধ্যে ঐক্য রয়েছে৷ এরমধ্যে মগ সম্পদায় ভগবান বুদ্ধের উপাসক৷ তারা বুদ্ধের শান্তির বাণীর ধারক ও বাহক৷ মগ সম্পদায়ের মানুষের শিক্ষার বিকাশে মনুবনকুলে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়৷ এজন্য সরকার ২৫ একর জমি দান করেছে৷ এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলে তিববত, জাপান, বাংলাদেশ সহ বিদেশ থেকে বহু ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে আসবে৷ অন্যদিকে, পিলাকে বহু আগে থেকে বৌদ্ধ শিল্প স্থাপত্য রয়েছে৷ ফলে পর্যটনের বিকাশও হবে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আগামীদিনে সাবম হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নগরী৷ এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অ’ল, লজিস্টিক হাব, ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট সহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজ শুরু হয়েছে৷ আগামীদিনে সাবমে আনুমানিক আড়াই লক্ষ লোকের রোজগার সৃষ্টি হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব আরও বলেন, সারা ভারতের মধ্যে প্রথম ১০ জন বৌদ্ধ ধর্মগুরুর মধ্যে মনুবনকুলের ড. ধম্মপ্রিয়া একজন৷ তিনি স্বর্ণপদক জয়ী ধর্মগুরু৷ শিলাছড়িতে রয়েছেন জাতীয়স্তরের স্বর্ণপদক জয়ী ক্রীড়াবিদ সান্দ্রাই মগ৷ অথচ পূর্বের সরকার এদের কোনও খবর নেয়নি৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনজাতিদের উন্নয়নে নতুন মানসিকতা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে৷ নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মধ্যে রাজ্যে এন সি আর টি কোর্স চালু করা হয়েছে৷ সি বি এস ই কোর্স চালু করা হয়েছে শিক্ষার উন্নয়নে৷ তাছাড়াও অটল জলধারা মিশনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে৷ সৌভাগ্য যোজনার মাধ্যমে বিনা খরচে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে৷ কিষাণ সম্মাননিধির মাধ্যমে ক’ষকদের হাতে বছরে ৬ হাজার টাকা সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে৷ কর্মচারীদের তিন শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া হয়েছে৷ এজন্য কোনও আন্দোলন করতে হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবকা সাথ সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাসের দিশায় সরকার কাজ করছে৷ অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিধায়ক শঙ্কর রায়, মগ জনজাতি গোষ্ঠীর প্রধান সমাজপতি সুুচলা মগ, দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার জেলাশাসক দেবপ্রিয় বর্ধন এবং সাবম মহকুমার মহকুমা শাসক তড়িৎকান্তি চাকমা৷
রাজ্যের বর্তমান সরকার জনজাতিদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিয়েছে৷ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি জনজাতিদের চিরাচরিত সংস্ক’তি যাতে আরও বিকশিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছে৷ আজ শান্তিরবাজার মহকুমার বীরচন্দ্রমনুর তৈকর্ম দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয়ের মাঠে রিয়াং জনজাতি গোষ্ঠীর প্রধান অনিল রিয়াং কে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব এ কথা বলেন৷ তিনি বলেন, জনজাতিরা যাতে অন্যান্যদের চেয়ে কোন দিকে পিছিয়ে না থাকেন সে জন্য প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে৷
অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সড়কের উন্নয়নের পাশাপাশি জনজাতি অধ্যষিত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ৩৬২ কোটি টাকার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷ এডিসি এলাকার রাস্তাঘাট, পানীয়জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার সুুফল যাতে সবার কাছে পৌঁছে যেতে পারে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে৷ সবকা সাথ সবকা বিকাশ এই দিশায় রাজ্য সরকার কাজ করে চলেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সমাজের সার্বিক উন্নয়নই সরকারের একমাত্র লক্ষ্য৷ তিনি শক্তিশালী এবং সর্বশ্রেষ্ট ত্রিপুরা গঠনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে সবার প্রতি আহ্বান জানান৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন৷ জনজাতি গোষ্ঠীর সমাজপতিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজ্যের বর্তমান সরকার সম্মানিত করছে৷ শক্তিশালী সমাজ গঠনে জনজাতি গোষ্ঠীগুলি যে অবদান রেখেছে তার জন্যই তাদের সম্মানিত করা হচ্ছে৷ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলাশাসক ও সমাহর্তা দেবপ্রিয় বর্ধন৷ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক প্রমোদ রিয়াং, বকাফা বিএসি’র চেয়ারম্যান গৌরিশঙ্কর রিয়াং, দক্ষিণ জেলার পুলিশ সুুপার কুলবন্ত সিং, শান্তিরবাজার মহকুমার মহকুমা শাসক প্রমুখ৷