নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ২৭ জানুয়ারি৷৷ ত্রিপুরার ভবিষ্যৎ উজ্জল ও সুুন্দর৷ আগামী দিনগুলিতে ত্রিপুরা এক সমৃদ্ধ রাজ্যে পরিণত হবে৷ আজ আসাম রাইফেলস ময়দানে ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং সম্মিলিত বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করে রাজ্যপাল রমেশ বৈস একথা বলেন৷ আসাম রাইফেলস ময়দানে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের মূল অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব, বিধানসভার অধ্যক্ষ রেবতী মোহন দাস, মুখ্যসচিব মনোজ কুমার এবং রাজ্যপুলিশের মহানির্দেশক এ কে শুক্লা উপস্থিত ছিলেন৷ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাজ্যপাল বলেন, ত্রিপুরার এক বড় সমস্যা ছিলো মিজোরাম থেকে ত্রিপুরায় এসে অবস্থানকারী ব জনজাতিরা, যা এখন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলে সমাধান করেছে৷ এখন তাদের ত্রিপুরাতেই সসম্মানে পুনর্বাসন দেওয়া হবে৷
রাজ্যপাল বলেন, গণতন্ত্রে হিংসার কোনও স্থান নেই এবং এমন কোনও সমস্যা নেই যা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না৷ ড. আম্বেদকরও বলেছিলেন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সাংবিধানিক পন্থাই শ্রেষ্ঠ পথ৷ এই শুভ মুহর্তে তিনি সীমান্তে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর জওয়ানদের অভিনন্দন জানান৷ যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনদান দিয়েছিলেন সেই শহীদদের প্রতি সম্মান জানান এবং অভ্যন্তরীণ কাজে রত আধাসামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকেও তিনি অভিনন্দন জানান৷ উত্তর-পূর্বা’লের রাজ্যগুলির মধ্যে আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে ছোট রাজ্য হলেও ত্রিপুরা তার বিবিধ ভাষা, রীতিনীতি, বেশভূষা, ধর্মের উপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে৷ রাজ্য সরকার রাজ্যের বিকাশের লক্ষ্যে বহু পদক্ষেপ নিয়েছে৷ রাজ্যে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ ক’ষিনির্ভর৷ তাই ক’ষি ক্ষেত্রের বিকাশ ছাড়া রাজ্যের বিকাশ সম্ভব নয়৷ রাজ্য সরকার ক’ষকদের আয় পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে ক’ষির সাথে পশুপালন, মৎস্যচাষ ও উদ্যানচাষের উপরও জোর দিচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্মাননিধি যোজনায় ১.৯০ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ক’ষকের একাউন্টে ১১৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা বীজ, সার ইত্যাদি ক্রয় করতে পারেন৷
তাছাড়া তাঁদের কারিগরি শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৪টি ক’ষক বন্ধ কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷ ক’ষকদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার লক্ষ্যে সমস্ত বাজারগুলিকে ত্রক্ষ্মঞ্ছঙ্ঞ্চ প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত করা হবে৷ ক’ষকদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য দিতে এফ সি আই-এর সাথে মিলে ধান ক্রয় করা হচ্ছে৷ প্রাক’তিক বিপর্যয়ের ক্ষতি থেকে ক’ষকদের বাঁচাতে ৩০,০০০ ক’ষককে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার আওতায় আনা হয়েছে৷ সরকার জৈবচাষকে উৎসাহিত করছে৷ ৬,০০০ হেক্টর এলাকায় বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ৯০০০ ক’ষককে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হয়েছে৷ তাদের উৎপাদিত ফসল ’ত্রিপুরা অরগ্যানিক’ ব্যাণ্ড নামে বিক্রি হচ্ছে যার ট্যাগ লাইন হলো ’মন্ত্রা টু হেলদি লিভিং’৷
রাজ্যপাল বলেন, কোনও রাজ্যের বিকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব রয়েছে৷ তাই রাজ্য সরকার হীরা নীতির অঙ্গ হিসেবে সড়ক, রেল, বায়ু ও জলপথে ত্রিপুরাকে সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে৷
দেশভাগের ফলে ত্রিপুরা যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশ সরকারের সাথে সেই জলপথ ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চলছে৷ আশা করা হচ্ছে শীঘই চ-গ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে মালপত্র আনা নেওয়া শুরু করা যাবে৷ সোনামুড়া দাউদকান্দি জলপথ খুলে গেলে বাইরে থেকে মালপত্র পরিবহণের খরচ কমে যাবে৷ আগরতলা-আখাউড়া রেললাইনও এই দিশায় এক মাইলফলক হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন৷
রাজ্যপাল বলেন, আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের জন্মদিনকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আগরতলা বিমানবন্দরের নামও তার নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে৷ ত্রিপুরার প্রাক’তিক সম্পদ যেমন বাঁশ, চা, রাবার, সব্জি, বাগিচা ফসল, মশলা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ গড়ে উঠার জন্য রাজ্য সরকার উৎসাহদানে ক’তসংকল্প৷ এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়লে জনগণের আয়ও বাড়বে৷
তিনি বলেন, শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হলে পরিকাঠামোর উন্নয়নও দরকার৷ আগামী তিন বছরে জাতীয় সড়কের উন্নয়নে ৪০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে৷ বিদ্যৎ ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটানো হচ্ছে৷ রাজ্য সরকার ’ত্রিপুরা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন পলিসি-২০১৭’-কে আরও আকর্ষণীয় করা হয়েছে এবং হোটেল ব্যবসা, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রকে এই নীতির আওতায় আনা হয়েছে৷ সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি সুুযোগ সুুবিধা দিয়ে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা এবং কর্মসংস্থানের সুুযোগ সৃষ্টি করা৷ নতুন শিল্পোদ্যোগ স্থাপনে বিভিন্ন দপ্তর ও এজেন্সির অনুমোদন যাতে দ্রত পাওয়া যায় সেজন্য রাজ্য সরকার আইন তৈরি করে সহজতর করার চেষ্টা করেছে৷ রেগায় রাজ্য সরকার উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রামীণ রোজগার সৃষ্টি করেছে৷ ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেগা প্রকল্পে রাজ্যের শ্রম বাজেট বাড়িয়ে ৪ কোটি শ্রমদিবস করা হয়েছে৷ এসব উদ্যোগের কারণে রাজ্যে শিল্পোন্নয়নে সুুবিধা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন৷ রাজ্যে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে৷ বিশেষ করে ছবিমুড়া, ঊনকোটি, ডম্বর-এর মতো স্থানগুলির জাতীয় স্তরে প্রচারের প্রয়োজন৷ সেজন্য রাজ্য সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷
রাজ্যপাল বলেন, সুুস্থ ও শিক্ষিত সমাজের উপর ভিত্তি করেই এক সুুখী, সম্পন্ন ও স্বনির্ভর রাজ্য গড়ে তোলা যায়৷ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজ্য সরকার ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ১ম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এন সি ই আর টি পাঠ্যক্রম চালু করেছে৷ তাই শিক্ষাবর্ষও জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর থেকে বদলে এপ্রিল-মার্চ হয়েছে৷ ত’তীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার গুণগতমান বাড়ানোর লক্ষ্যে ’নতুন দিশা’ নামক অভিযান বাস্তবায়ন করা হয়েছে৷ শিক্ষাকে আরও রোজগারমুখী করার লক্ষ্যে ২৪টি বিদ্যালয়ে এই প্রথম পেশাদারি শিক্ষাদান শুরু হয়েছে৷ রাজ্যের আই এ এস পরীক্ষার্থীদের জন্য ’লক্ষ্য’ নামক নতুন প্রকল্প চালু হয়েছে৷ তেমনি এসেছে বি এড পড়ার সুুযোগ করে দিতে ’মুখ্যমন্ত্রী বি এড অনুপ্রেরণা যোজনা’৷ রাজ্যপাল বলেন, সকলের সুুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে আয়ুমান ভারত প্রকল্পে প্রতিটি দরিদ্র পরিবারকে বিনামূল্যে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার সুুবিধা দেওয়া হচ্ছে৷ এখন পর্যন্ত রাজ্যে এই প্রকল্পে ৪.৬৫ লক্ষ ই-কার্ড বিতরণ করা হয়েছে৷ প্রায় ৪৭,০০০ জন রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসার সুুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ আগরতলায় নতুন ক্যান্সার হাসপাতাল চালু হয়েছে এবং জি বি হাসপাতালে ’সুুপার স্পেশালিটি ব্লক’-এর নির্মাণ খুব শীঘই শেষ হবে৷
মহিলা ও শিশুদের পুষ্টি ও রোগ সংক্রান্ত বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ’পোষণ অভিযান’ রূপায়ণ করা হচ্ছে৷ ৪৫,০০০-এর বেশি গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে৷ মহিলা ক্ষমতায়নের জন্যও পুলিশে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিটি ঘরে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে সরকার প্রতি’াবদ্ধ৷ সেজন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷ চার লক্ষের অধিক সুুবিধাভোগীকে মাসিক ১০০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হচ্ছে৷ ১ লক্ষ ১০ হাজার লক্ষ বনবাসীকে রেগা প্রকল্পে জীবিকার্জনের সুুযোগ করে দেওয়া হয়েছে৷
আজ দেশের ৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবস রাজধানী আগরতলায় যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়৷ সকালে গান্ধীবেদীতে এবং পোস্ট অফিস চৌমুহনির শহীদবেদীতে মাল্যদান করেন শিক্ষামন্ত্রী রতনলাল নাথ৷ আসাম রাইফেলস মাঠে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজে অংশ নেন বি এস এফ, আসাম রাইফেলস, সি আর পি এফ, টি এস আর, পশ্চিম জেলা পুলিশের পুরুষ ও মহিলা বাহিনী, ফরেস্ট গার্ড, হোম গার্ডের জওয়ান, এন সি সি বয়েজ, এন সি সি গার্লস, বয়েজ স্কাউট, গার্লস গাইড, এন এস এস, সিভিল ডিফেন্স ও আসাম রাইফেলস পাবলিক সুকল৷ কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী দলগুলির মধ্যে ৯টি ছিলো সিকিউরিটি ক্যাটাগরির এবং ৭টি ছিলো নন-সিকিউরিটি ক্যাটাগরির৷ উৎকর্ষতার নিরিখে কুচকাওয়াজে সিকিউরিটি ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছে আসাম রাইফেলস, দ্বিতীয় হয়েছে বি এস এফ এবং যুগ্মভাবে ত’তীয় হয়েছে টি এস আর দ্বিতীয় বাহিনী ও পশ্চিম জেলা মহিলা পুলিশ বাহিনী৷
নন-সিকিউরিটি ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়েছে আসাম রাইফেলস পাবলিক সুকল, দ্বিতীয় হয়েছে এন এস এস, যুগ্মভাবে ত’তীয় হয়েছে এন সি সি গার্লস ও গার্লস গাইড৷ অনুষ্ঠানে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ২০১৯ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে এবং ২০১৭-১৮ সালে যেসমস্ত পুলিশ অফিসার এবং কর্মীগণ ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীর বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন রাজ্যপাল রমেশ বৈস৷ ২০১৯ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসের রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন সুুবেদার জয়প্রকাশ যাদব (সি আই এ টি সুকল, কচুছড়া)৷ প্রজাতন্ত্র দিবস ২০১৯ উপলক্ষে যারা পুলিশ পদক পেয়েছেন তারা হলেন টি এস আর ত’তীয় বাহিনীর অ্যাসিস্টেন্ট কমাণ্ডেন্ট বর্তমানে এস পি নর্থ ফণীন্দ্র কুমার জমাতিয়া, এস পি সিকিউরিটি সত্যজিৎ দেবনাথ, ইন্সপেক্টর সরোজ ভ-াচার্য, টি এস আর দ্বিতীয় বাহিনীর সুুবেদার ভীম সিং, সুুবেদার সি টি আই বিপ্লব কুমার দেব, টি এস আর নবম বাহিনীর হাবিলদার রতনলাল পোদ্দার৷ ২০১৭-১৮ সালে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীর পদক পেয়েছেন সাব-ইন্সপেক্টর প্রাণতোষ কর, সাব-ইন্সপেক্টর বীরেন্দ্র দেববর্মা, এন বি (জি ডি) রমাকান্ত ভ-, হাবিলদার প্রেম শংকর৷ রাজ্যপাল অনুষ্ঠানে কুচকাওয়াজে বিজয়ী দলগুলির হাতেও পুরস্কার তুলে দেন৷
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে শিক্ষা দপ্তর এবং যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া দপ্তরের উদ্যোগে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বর্ণাঢ্য সাংস্ক’তিক অনুষ্ঠান ও ভারতীয়ম পরিবেশন করে৷ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ উপস্থিত ছিলেন৷