ই-রিক্সা চালকের আত্মহত্যা, ক্ষুব্ধ সহ-চালকদের পথ অবরোধ, উত্তেজনা আগরতলায়, মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্যের আশ্বাস, অনুমোদনহীন ই-রিক্সা দুশ্চিন্তায় ফেলল রাজ্য সরকারকে

নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৩ আগস্ট ৷৷ অনুমোদনহীন ই-রিক্সা রাজ্য সরকারকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে৷ ওই ই-রিক্সা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে এক চালকের আত্মহত্যার ঘটনায় আজ আগরতলা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল৷ ই-রিক্সা চালকদের অবরোধ আন্দোলনে প্যারাডাইস চৌমুহনী এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দিয়েছিল৷ এমনকি ই-রিক্সার রেজিস্ট্রেশনে মুখ্যমন্ত্রী আরো একমাস সময় দেওয়ার পরও তাঁরা অবরোধ তুলে নেননি৷ অবশেষে পুলিশ ও টিএসআর কঠোর হতেই তাঁরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন৷ এই ঘটনায়, আজ বিকেল পাঁচটা থেকে রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত শহর আগরতলায় পরিস্থিতি থমথমে হয়েছিল৷ তবে, অনুমোদনহীন ই-রিক্সা ইস্যু রাজ্য সরকারকে আগামী দিনে আবারও বেকায়দায় ফেলবে, তা মনে করা অস্বাভাবিক নয়৷

শনিবার আগরতলায় প্যারাডাইস চৌমুহনীতে অনুমোদনহীন ই-রিক্সা চালকরা পথ অবরোধ করেন৷ ছবি- নিজস্ব৷

অনুমোদনহীন ই-রিক্সা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার৷ মূলত, ত্রিপুরা হাইকোর্টের রায়ের কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার৷ ফলে, ১ আগষ্ট থেকে রাজ্যে ই-রিক্সা চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ হওয়ায় প্রচুর ই-রিক্সা চালকের রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷

আজ আগরতলায় এক ই-রিক্সা চালক আত্মঘাতি হয়েছেন৷ ইন্দ্রনগর ভাড়া বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন বিবেকানন্দ মালাকার(৪৯)৷ তাঁর স্ত্রী জানিয়েছেন, গত তিনদিন চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর স্বামী৷ কারণ, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি ই-রিক্সা ক্রয় করেছিলেন৷ ফলে, এখন অনুমোদন না থাকার কারণে ই-রিক্সা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ প্রচন্ড চাপ দিচ্ছেন ঋণ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য৷ তাঁর স্ত্রীর বলেন, গতকাল রাতে ভিষণ উলটাপাল্টা করছিলেন৷ ঋণ কিভাবে মেটাবেন সেই চিন্তায় বাড়িতে সকলের সাথে বাজে ব্যবহার করেছেন৷ কিন্তু, আত্মহত্যার পথ তিনি বেছে নেবেন, এমনটা আমরা কেউ ভাবিনি, বলেন ওই ই-রিক্সা চালকের স্ত্রী৷ তিনি জানান, রাতে সকলে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তিনি বিষপান করেন৷ আজ সকাল ৮টা নাগাদ তাকে জি বি হাসপাতালে নিয়ে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷

ওই ই-রিক্সা চালকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই অন্য ই-রিক্সা চালকরা জি বি হাসপাতাল চত্বরে জড়ো হতে শুরু করেন৷ তারা সকলে মিলে হাসপাতল চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন৷ তাঁদের বক্তব্য, সরকারের নাকের ডগা দিয়ে অনুমোদনহীন ই-রিক্সা বিক্রি হয়েছে৷ অথচ, তখন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ কিন্তু, এখন হঠাৎ করে সমস্ত ই-রিক্সা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে৷ তাঁদের অভিযোগ, অনুমোদনহীন ই-রিক্সা নিষিদ্ধ ঘোষণায় প্রচুর চালক সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ জনৈক ই-রিক্সা চালক রঞ্জিত গোপ বলেন, রাজ্য সরকার ডিলারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না৷ তাঁরা অনুমোদনহীন ই-রিক্সা বিক্রি করেছে এবং এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন৷ তাঁর অভিযোগ, বৈধ কাগজপত্র চেয়েও ডিলারদের কাছ থেকে তা পাওয়া যাচ্ছে না৷ সেই অভিযোগ পুলিশে জানানো সত্বেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না৷ তাতে স্পষ্ট, ই-রিক্সা চালকদের সর্বনাশ হয়ে গেলেও সরকারের তা নিয়ে ভাববে না, ক্ষোভের সুরে বলেন তিনি৷

রঞ্জিত গোপের বক্তব্য, ঋণের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আজ একজন ই-রিক্সা চালক আত্মঘাতি হয়েছেন৷ এমন আরো ঘটনা সারা রাজ্যেই ঘটতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন৷ এদিকে, আত্মহত্যার ঘটনায় জি বি হাসপাতাল চত্বর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল৷ ফলে, পরিস্থিতি সামাল দিতে পৌছান বিধায়ক রতন চক্রবর্তী এবং বিধায়ক সুশান্ত চৌধুরী৷ তাঁরা ই-রিক্সা চালকদের সংযত থাকার অনুরোধ করেন৷ সাথে, সরকার তাদের পাশে রয়েছে, এই আশ্বাস দিয়েছেন৷ বিধায়ক রতন চক্রবর্তী বলেন, ই-রিক্সা চালকের আত্মহত্যা ভিষণ দু:খজনক ঘটনা৷ কিন্তু, হাইকোর্টের রায়ে রাজ্য সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, তা ই-রিক্সা চালকদের বুঝতে হবে৷ তিনি বলেন, ওই আত্মঘাতি ই-রিক্সা চালকের পরিবারকে সহায়তার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করবেন তিনি৷ সাথে যোগ করেন, সমস্ত ই-রিক্সা চালকের পাশে রয়েছে রাজ্য সরকার৷ তিনি সকল ই-রিক্সা চালকদের হতাশ না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন৷

বিধায়ক সুশান্ত চৌধুরী বলেন, ই-রিক্সা চালকদের একটি প্রতিনিধি দল আজ সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য তাঁদের পরামর্শ দিয়েছি৷ কারণ, সমস্যা সমাধানে আলোচনাই একমাত্র পথ৷ তিনি বলেন, কেউই আইনের উর্দ্ধে নন৷ তবে, ওই আত্মঘাতি ই-রিক্সা চালকের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে রাজ্য সরকার৷

কিন্তু, বিকেল নাগাদ ই-রিক্সা চালকরা প্যারাডাইস চৌমুহনীতে জড়ো হন এবং গণবস্থানে বসে যান৷ এরই মাঝে রাস্তা অবরোধ করেন তারা৷ পুলিশ তাদের তুলে দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা মাটিতে শুয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন৷ ফলে, পুলিশকে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলার পথ খঁুজে বের করতে হয়েছে৷

ত্রিপুরা ই-রিক্সা শ্রমিক সমিতির সভাপতি ইমাম হোসেন জানান, রাজ্য সরকারে অমানবিক সিদ্ধান্তের বলি হয়েছেন একজন ই-রিক্সা চালক৷ রাজ্য সরকার অনুমোদনহীন ই-রিক্সা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আজ তাঁদের সহকর্মীকে প্রাণ দিতে হতো না৷ তিনি বলেন, ই-রিক্সা চালকরা ভিষণ নিরুপায় হয়ে আজ পথে নেমেছেন৷ কারণ, সরকার তাঁদের বিষয়ে না ভাবলে আরো অনেকেই এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন৷ তিনি বলেন, ই-রিক্সা রেজিস্ট্রেশনে আরো একমাস সময়সীমা বাড়াতে হবে৷ পাশাপাশি, আত্মঘাতি ই-রিক্সা চালকের পরিবারকে সহায়তার দাবি জানান তিনি৷

এদিকে, রাত আটটা নাগাদ ভারতীয় মজদুর সংঘের সাধারণ সম্পাদক অসীম দত্তের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল এ-বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের সাথে আলোচনা করেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অসীমবাবু বলেন, রাজ্য সরকার ই-রিক্সা রেজিস্ট্রেশনে আরো এক মাস সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ তাছাড়া, আত্মঘাতি ই-রিক্সা চালক বিবেকানন্দ মালাকারের পরিবারকে মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল ১ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা এবং তার ছেলেকে সরকারী চাকুরী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তবে, এক মাসের মধ্যে সকলেই রেজিস্ট্রেশন করতেই হবে৷ তাতে, বীমাও থাকতে হবে৷

কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি সত্বেও প্যারাডাইস চৌমুহনীতে অবরোধকারীরা উঠে যাননি৷ তখন পুলিশ ও টিএসআর তাদের প্রতি কঠোর মনোভাব নেন৷ তাতেই, তারা কিছুক্ষণের মধ্যে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন৷ রাত প্রায় ৯টা নাগাদ অবরোধ প্রত্যাহার হয়েছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *