সখী, বুদ্ধিজীবী কাদের কয়

৷৷ সায়ন্তক চৌধুরী৷৷

কাঁধে শান্তি নিকেতনি চটের থলে৷ পরনে পায়জামা আর হাঁটু থেকেও নিচে ঝুলানো পাঞ্জাবি৷ সেই পাঞ্জাবি খাদির হলেতো কথা নেই৷ পাঞ্জাবির গায়ে যদি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের ছবি আঁকা থাকে তাহলেতো আরও চমৎকার৷ তবে পায়ে থাকতে হবে কোলাপুরি  স্যান্ডেল৷ এই সবের যোগসূত্র ঘটলে একজন ব্যক্তি বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন৷ রাতারাতি তিনি হয়ে উঠেন বুদ্ধিজীবী৷ এবং এমন বুদ্ধিজীবীর তকমা গায়ে একবার সেঁটে গেলে তাকে আর পায় কে? পেটে বিদ্যে থাকুক আর নাই থাকুক চলনে বলনে তিনি যেন বিদ্যার জাহাজ বনে যান৷ বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠান থেকে তার ডাক আসে৷ কালক্রমে তিনি যেন একটা কেউকেটা হয়ে চোখ কান খোলা রেখে বুদ্ধিজীবীর ভাল করে সমাজ জীবনে নিজের গুরুত্ব বোঝাতে শান্তি নিকেতনি ঝোলা কাঁধে ঝুলিয়ে চলাফেলা করেন৷

রাজ্যে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা কম নয়৷ মানুষ তাদেরকে কি চোখে দেখে তা ভাবার মত তাদের সেই বোধশক্তি নেই৷ তাদের ভাবখানা হল তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই৷ এই সোনার হরিণ বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন রূপে তাদের হাতে ধরা দেয়৷ এই ধরনের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মূল টার্গেট থাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সান্নিধ্য লাভ কিংবা পারতপক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে তোলা একটি ছবি সংগ্রহ করা৷ তারপর আর ওই বুদ্ধিজীবীকে পায় কে? তাদের বিচরণ ক্ষেত্রে কোনও সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান, সরকারী পর্যায়ে কোনও সেমিনার কিংবা কোনও ঢাউস সাইজের সরকারী অনুষ্ঠান৷ আর সেই অনুষ্ঠানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকলে তো তাধিনধিন নাচের উপক্রম হয় ওইসব বুদ্ধিজীবীর৷ ওই সব বুদ্ধিজীবীকে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসেও ঘুরতে দেখা যায়৷ উদ্দেশ্য একটাই৷ তা হল, যে সব অনুষ্ঠানে তারা দু’চার কথা বলেছেন সেই সব অনুষ্ঠানের সংবাদ ফলাও করে প্রচার করা৷ তবে, সংবাদে সেই বুদ্ধিজীবীর নাম থাকতে হবে৷ এ জাতীয় বুদ্ধিজীবীরা আবার বিভিন্ন সংস্থা থেকে সম্বর্ধনাও পেয়ে থাকেন৷ এমন সম্বর্ধনার পেছনে যে একটা লেনদেনের সম্পর্ক থাকে তা সেই বুদ্ধিজীবী ও সংস্থার কর্তৃপক্ষ ছাড়া ঘুণাক্ষরেও কেউ জানেন না৷ বুদ্ধিজীবী মঞ্চে সংস্থার কর্তৃপক্ষের হাত থেকে মানপত্র এবং উত্তরীয় নিচ্ছে৷ এমন দৃশ্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে৷ বিভিন্ন সংবাদপত্রে ছবি ছাপানো হচ্ছে৷ তার অর্থ হল সেই বুদ্ধিজীবী আকাশে উড়ছে৷ সরকারী কোন প্রতিবাদী মিছিলে তাদেরকে দেখা যায় সামনের সাড়িতে৷ বিরোধী দলের কোনও প্রতিবাদী মিছিলে তাদের টিকিটিও দেখা যায় না৷ কেননা, বিরোধী দলের মিছিলে সরকারী দলের নেতারা তাদেরকে দেখলে তাদের মাথার টিকি যে কেটে ফেলবে৷ সুতরাং কাজ কি ওপথে যাওয়ার৷ তার চেয়ে সরকারী উমেদারীকরণে যে অনেক বেশি লাভবান হওয়া যাবে৷

এই ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করতে অনেকে ছাড়েন না৷ তাদের বক্তব্য হল, কাদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা যাবে তা স্পষ্ট নয়৷ তাদের সোজাসুজি প্রশ্ণ হল, যে বুদ্ধি বেঁচে জীবন ধারণ করে তারাই তো বুদ্ধিজীবী৷ সেই ক্ষেত্রে সকল মানুষতো বুদ্ধিজীবী৷ তা হলে বিশেষ একটা শ্রেণীকে কেন এমন তকমা দেয়া হল? যে কাঠমিস্ত্রি সেও একটা কাঠকে কিভাবে ডাইনিং টেবিলে পরিণত করা হবে তাও বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেন৷ সেই অর্থে কাঠমিস্ত্রিও তো বুদ্ধিজীবী৷ ফসল উৎপাদনেও চাষিদেরকে বুদ্ধি খাটাতে হয়৷ জেলেদেরকেও বুদ্ধি খাটিয়ে পুকুর কিংবা নদী বা সাগরে জাল ফেলতে হয়৷ কুমোরকেও বুদ্ধি খাটিয়ে মাটির জিনিষপত্র তৈরী করতে হয়৷ চোর-ডাকাতদেরকেও বুদ্ধি করে চুরি ডাকাতি করতে হয়৷ তবে সেই বুদ্ধি সুবুদ্ধি নয়৷ দুর্বুদ্ধি বটে৷ তবে বুদ্ধিইতো৷ তাই বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা নিরূপনে এক শ্রেণীর উদারবাদী লোক গলদঘর্ম হচ্ছেন৷ কেননা, তাদের বক্তব্য হল সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ বুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করে৷ তাই বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার হদিশ তারা খঁুজে পাচ্ছেন না৷ তাইতো তাদেরও প্রশ্ণ- সখী, বুদ্ধিজীবী কাদের কয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *