আগরতলা, ১০ জানুয়ারি : শান্তি ও উন্নয়নের সাথে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলীকরণ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। স্বাভাবিক ভাবেই ত্রিপুরা বিধানসভায় রাজ্যপালের ভাষণে ওই বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। রাজ্যের অর্থনৈতিক মান উন্নয়নে জনজাতি অংশের জনগণকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া এবং আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে কর সংগ্রহে সাফল্য রাজ্যপালের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আজ শুক্রবার ত্রিপুরা বিধানসভায় রাজ্যপাল ইন্দ্রোসেনা রেড্ডি নাল্লু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, উন্নয়নের পথে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলার নীতিই হল ‘সবকা সাথে সবক বিকাশ’। ওই নীতি ত্রিপুরায় গভীরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
এদিন রাজ্যপাল বলেন, ২০২৪ সালে ভারতবাসী একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, উন্নয়নমুখী ও দুর্নীতিমুক্ত শাসন ব্যবস্থার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকারে তৃতীয় বারের জন্য আস্থা দেখিয়েছেন। ত্রিপুরা সরকারও বিকাশের পথে এগিয়ে চলেছে। তাই তিনি গর্বের সাথে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা এবং রাজ্য নেতৃত্বের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে এ রাজ্যে পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, কৃষি এবং জনজাতি কল্যাণ সহ সমস্ত ক্ষেত্রেই অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি।
তাঁর কথায়, রাজ্য সরকার নাগরিকদের আর্থ সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য অবিরাম কাজ করে চলেছে। তাঁর দাবি সমাজের অন্তিম ব্যক্তির উন্নয়ন সাধন হচ্ছে ত্রিপুরার উন্নয়নের রূপরেখার মূল মন্ত্র। সেজন্য মহিলা, শিশু ও অবহেলিত জাতিগোষ্ঠী সহ সমাজের দুর্বল ও অবহেলিত মানুষের উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জোর গলায় বলেন, দারিদ্র্যদূরীকরণ কর্মসূচি, দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে ত্রিপুরা সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন সমাজ গঠনে কাজ করে চলেছে। তাতে প্রতিটি ব্যক্তি রাজ্যের প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধিতে ভূমিকা নেবে এবং তাঁর সুফলও ভোগ করবে।
এদিন তিনি বলেন, শান্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে নেওয়া এক উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের ফলে ভারত সরকার, ত্রিপুরা সরকার এবং তিপ্রা মথার মধ্যে ২০২৪ সালের ২ মার্চ এক ঐতিহাসিক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ত্রিপুরার জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হবে।
ত্রিপুরায় সন্ত্রাসবাদের স্থায়ী সমাধানে কেন্দ্র ও রাজ্যের গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন রাজ্যপাল ইন্দ্রসেনা রেড্ডি নল্লু। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ভারত সরকার ও ত্রিপুরা সরকার নিষিদ্ধ ঘোষিত দুই বৈরী সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (এন এল এফ টি) এবং ওল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স ( এ টি টি এফ) – এর সাথে একটি সমঝোতা পত্র সাক্ষর করেছে এবং ওই দুটি বৈরী দল ভেঙে দিয়ে মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছে। তাঁর কথায়, এই চুক্তি অনুসারে ভারত সরকার ত্রিপুরার জনজাতি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের জন্য ২৫০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ অনুমোদন দিয়েছে।
আজ রাজ্যপাল ত্রিপুরায় রিয়াং শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্যও রাজ্য সরকারকে বাহবা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, মিজোরাম থেকে আগত ও ত্রিপুরায় পুনর্বাসিত ব্রু পরিবারগুলোকে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গণবন্টন ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬,২৫০ টি ব্রু পরিবারের ২২০০০ জন ওই গণবণ্টন ব্যবস্থার আওতায় এসেছেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার, ত্রিপুরা, মিজোরাম সরকার এবং ব্রু সংগঠনের মধ্যে চতুরপাক্ষিক চুক্তির অধীনে প্রতিটি পুনর্বাসিত ব্রু পরিবারকে ১২০০ বর্গ ফুট গৃহস্থ জমি, বাড়ি নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা, চার লক্ষ টাকা এককালীন আর্থিক সহায়তা, ৫০০০ টাকা মাসিক নগদ সহায়তা এবং দুই বছরের জন্য বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হচ্ছে। পুনর্বাসন এলাকায় রাস্তা, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, রেশন দোকান এবং সমবায় সমিতি তৈরির মত সাধারণ উন্নয়নমূলক কাজ করা হচ্ছে। যুবকদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পও চলছে, প্রত্যয়ের সুরে বলেন রাজ্যপাল।
এদিন রাজ্যপাল ২০২৪ সালে রাজ্যে ভয়াবহ বন্যায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।এদিন তিনি বলেন, ২০২৪ সালে উনিশ থেকে তেইশ আগস্ট সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে রাজ্য ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের সম্মুখীন হয়েছিল। ফলে ওই সময় রাজ্যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই বন্যা ও ভূমিধসের জন্য ত্রিপুরার ৩৮ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং ৩.৭ লক্ষ মানুষকে বিভিন্ন ট্রেন শিবিরে আশ্রয় নিয়ে হয়েছিল। তাঁর দাবি, ত্রিপুরা সরকার প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স তহবিল থেকে চার লক্ষ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রী ন্যাশনাল রিলিফ তহবিল থেকে দুই লক্ষ টাকা করে আর্থিক সহায়তা করেছে।
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ওই বন্যায় রাজ্যে কৃষি, পরিকাঠামো, জীবিকা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১৪২৪৭ কোটি টাকার অধিক ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে। তাঁর দাবি, ত্রিপুরা সরকার ভয়াবহ বন্যার ওই সংকটজনক পরিস্থিতি মোকাবিলায় এসডি আর এ এন ডি আর এফ, ভারতীয় বায়ু সেনা, রাজ্যের সরকারি আধিকারিক ও স্বেচ্ছা সেবীদের মোতায়েন করেছিল। রাজ্যে ৮৮৯ টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। সেখানে বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় ছাড়াও খাদ্য ও চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হয়েছে।
এদিন রাজ্যপাল ভীষণ সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত ত্রিপুরায় ১০০৫ কোটি টাকা জিএসটি, ৩০৭ কোটি টাকা ভ্যাট এবং ২৩১ কোটি টাকা আবগারি শুল্ক ত্রিপুরা সরকার আদায় করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে জিএসটি ৮.৩৭ শতাংশ, ভ্যাট ৯ শতাংশ এবং আবগারি শুল্ক ৪ শতাংশ সংগ্রহ বেড়েছে। সাথে তিনি যোগ করেন নাগরিকদের উৎসাহিত করতে সময়মতো কর প্রদানের জন্য ১৬৪ জনকে সম্মানিত করেছেন।
এছাড়া রাজ্যপাল এদিন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও পরিকাঠামো উন্নয়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য ত্রিপুরা সরকারের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর দাবি ত্রিপুরা উন্নয়নের দিশায় এগিয়ে চলেছে। তাতে তিনি বিধানসভার সকল সদস্যদের রাজ্যের উন্নতির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছন। তাঁর আবেদন, আমরা সবাই একসাথে একটি সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং আত্মনির্ভর ত্রিপুরার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করি।