।। সমীপকুমার দাস ।।গুয়াহাটি, ১৭ অক্টোবর (হি.স.) : ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারত সরকার, অসম সরকার এবং ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (এএএসইউ বা আসু) ও ‘অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’ (এএজিএসপি)-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপাক্ষিক অসম চুক্তি অনুসারে রাজ্যে বিদেশি শনাক্তকরণের ভিত্তিবৰ্ষ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাত পর্যন্ত কেন ধার্য করা হয়েছে? পরবর্তীতে ভিত্তিবৰ্ষকে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে ওই সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব আইনে কেন সংযোজন করা হয়েছে দফা ৬(এ)।
১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চ পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্ৰপতি ইয়াহিয়া খানের নিৰ্দেশে পূৰ্ব পাকিস্তানে অপারেশন সার্চলাইট শীর্ষক সামরিক অভিযানে ওই দেশের (পূর্ব পাকিন্তান) নাগরিকদের ওপর অকথ্য নিৰ্যাতন চালানো হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধাদের দমন ও নির্মূল করতে চালানো হয়েছিল নৃশংস অভিযান। পাক সেনার নিৰ্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছলে অসমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ঢল নেমেছিল হিন্দু বাঙালির স্রোত। ওই সব মানুষকে অসম থেকে বিতাড়িত করতে আসু ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
অসম চুক্তি অনুসারে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাত পর্যন্ত অসমে আগত অনুপ্রবেশকারীদের শৰ্তসাপেক্ষে নাগরিকত্ব প্ৰদানের ব্যবস্থা আছে।
এর পর সংযোজিত নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৬এ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে আবেদনের ভিত্তিতে ওঠে কয়েকটি প্ৰশ্ন। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ১৯৭১ সাল প্ৰত্যাহার হলে ডাস্টবিনের কাগজ হবে নাকি অসম চুক্তি? দ্বিতীয়ত ভিত্তিবর্ষ ১৯৫১ সাল হলে কি প্ৰয়োজন হবে অসম চুক্তির ৬ নম্বর দফা বাস্তবায়নের? তৃতীয়ত, ১৯৫১ সাল বিদেশি শনাক্তকরণের ভিত্তিবৰ্ষ হলে খিলঞ্জিয়ারা (ভূমিপুত্র) কি সাংবিধানিক সুরক্ষা পাবেন? চতুর্থত, ১৯৭১ সাল প্ৰত্যাহার হলে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কি ডাস্টবিনের কাগজে রূপান্তরিত হবে? পঞ্চমত, ১৯৭১ সাল প্ৰত্যাহার হলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) কি নিষ্প্ৰভ হয়ে যাবে? ষষ্ঠত, সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নিৰ্ধারিত ভিত্তিবৰ্ষ ‘সিএএ’-এর ওপর প্ৰযোজ্য হবে কি? সপ্তমত, ১৯৭১ সালকে বহাল রাখার যুক্তি কী? অষ্টমত, ১৯৭১ পর্যন্ত আগত বিদেশিদের নাগরিকত্ব দিতে কেন চেয়েছে আসু? নবমত, অসম সরকার কেন ১৯৭১ সালের সপক্ষে যুক্তি প্ৰদৰ্শন করেছে?ভারতের অন্য রাজ্যে নাগরিকত্বের ভিত্তিবৰ্ষ ১৯৫১, অথচ অসমে ১৯৭১ সাল।
আজ বৃহস্পতিবার দেশের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় প্ৰদান করে অসমে নাগরিকত্বের ভিত্তিবৰ্ষ ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চকেই নিৰ্ধারণ করেছে। এছাড়া ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার পর এখন রাজ্যবাসীর মুখে মুখে নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৬(এ)। ৬(এ) ধারা কী, কী কাজ, এই ধারা কেন গুরুত্বপূৰ্ণ? কীভাবে ধারাটি এই আইনে সংযুক্ত হয়েছে? তাছাড়া কেবল অসমের ক্ষেত্ৰে কেন এই ব্যবস্থা?
মূলত, ছয় বছরের বিদেশি খেদা আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট মাসে সম্পাদিত হয় ত্ৰিপাক্ষিক অসম চুক্তি। এর পর ওই বছরের ডিসেম্বরে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে এই আইনে ৬(এ) দফা সংযুক্ত করা হয়েছিল। নাগরিকত্ব আইনের এই দফার বলে ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাত পর্যন্ত অসমে প্ৰবেশকারী পূর্ব পাকিস্তানি (অধূনা বাংলাদেশ)-দের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্ৰদান করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ২৬ মাৰ্চের আগে বাংলাদেশ নামে কোনও দেশ ছিল না। তখন ছিল পাকিস্তানের অধীন পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত মহাযুদ্ধে ওই অঞ্চলের মানুষ ভারতীয় সেনার সহায়তায় ১৯৭১ সালের ২৬ মাৰ্চ পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করেছিলেন। সেই পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ গঠন হওয়ার পর এখনও ওই দেশ থেকে অসমে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ফলে অসমের জনবিন্যাস পরিবৰ্তন হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজ্যের খিলঞ্জিয়া (ভূমিপুত্র) মানুষজনের রাজনৈতিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক, অৰ্থনৈতিক – প্ৰতিটি ক্ষেত্ৰে এক বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ধরনের অবৈধ অনুপ্রবেশের জন্যই রাজ্যে ‘সারা অসম ছাত্ৰ ইউনিয়ন’ এবং ‘অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’-এর নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল ছয় বছরের অসম আন্দোলন। ৮৫৫ জন শহিদের বিনিময়ে পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ১৫ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভারত সরকার, অসম সরকার এবং আন্দোলনকারী ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ ও ‘অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’ (এএজিএসপি)-এর মধ্যে ত্রিপাক্ষিক ঐতিহাসিক অসম চুক্তি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, অসম চুক্তি সম্পাদনের পর ‘সারা অসম ছাত্ৰ ইউনিয়ন’-এর বহু নেতা ও কর্মী এবং ‘অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’-এর প্রায় সবাই ‘অসম গণ পরিষদ’ (অগপ) নামে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। অগপর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন আসু সভাপতি প্রফুল্লকুমার মহন্ত। ৮৬-র বিধানসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রফুল্ল মহন্তের নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছিল অগপ। অগপ এখন অসমে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম শরিক দল। ‘অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ’-এর কোনও অস্তিত্ব এখন না থাকলেও বহাল রয়েছে ‘সারা অসম ছাত্ৰ ইউনিয়ন’ সংক্ষেপে আসু।
ঐতিহাসিক এই অসম চুক্তি অনুসারেই অসমে বিদেশি শনাক্তকরণের জন্য ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাত নিৰ্ধারণ করা হয়। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের সে সময়ের পরিস্থিতির শিকার হয়ে অসমে প্ৰবজনকারীদের মানবিক দৃষ্টিতে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ৬ (এ) ধারা সংযোজন করে ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাতকে নিৰ্ধারণ করা হয়েছে।
এই ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি বা তার পর কিংবা ১৯৭১ সালের ২৫ মাৰ্চের মধ্যরাতের আগমুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ সহ কিছু নিৰ্দিষ্ট অঞ্চল স্থান থেকে অসমে যে সকল মানুষ এসেছেন এবং তখন থেকে সংশ্লিষ্টরা উত্তর-পূৰ্বাঞ্চলের এই রাজ্যের বাসিন্দা, তাঁরা ১৯৮৫ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুসারে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করবেন। তবে তাঁদের ১৮ ধারার অধীনে নিজদের নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।এদিকে বিভিন্ন সময় অসমে রাজনৈতিক কারণে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মতানৈক্যেরও সৃষ্টি হয়ে আসছিল।
সারা অসম ছাত্ৰ ইউনিয়ন ১৯৭১-এর সপক্ষে দাঁড়ালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক স্বাৰ্থে নানা সময়ত নানা স্থিতি অবলম্বন করছিল। কেউ কেউ সরকারিভাবে ১৯৭১-এর সপক্ষে শপতনামা দাখিল করলেও, আবার তারাই প্রকাশ্য সমাবেশে ১৯৫১ সালের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে অন্য এক পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে।
আজ ভারতের শীর্ষ আদালত অসম চুক্তিকে স্বীকৃতি প্রদান করে যে রায় প্রদান করেছে তাতে এই চুক্তি আইনগতভাবে বৈধ এবং প্রয়োগযোগ্য নীতি হিসেবে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এতে নাগরিকত্ব এবং অনুপ্রবেশকারী সমস্যাবলির সমাধান হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এছাড়া আজকের রায়ে অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগ কমিয়ে ভূমিপুত্রদের জাতিগত পরিচয় এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রক্রিয়া সম্পর্কে চলমান বিতর্কেরও অবসান ঘটবে।
কেবল তা-ই নয়, প্রশাসনিক সংস্কারের পথেও হাঁটতে বাধ্য হবে সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার এখন আন্তর্জাতিক সীমান্তে বেড়া দিতে, বিদেশী ট্রাইব্যুনালগুলিকে শক্তিশালী করতে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমি দখলের উদ্বেগগুলিকে মোকাবিলা করতে আরও চাপের সম্মুখীন হতে পারে৷আরও মনে করা হচ্ছে, আজকের রায় সম্ভবত অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং নাগরিকত্বের বিষয়ে অসমের নীতি গঠন করে এই অঞ্চলের আইনি ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।