কিশোর সরকার
ঢাকা, ২০ নভেম্বর (হি.স): খোদ পদ্মা তীরের মানুষই পদ্মার সেই ঐতিহ্যবাহী ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মাওয়া, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া অথবা গোয়ালন্দ ঘাটে, পদ্মার ইলিশ বলে যে ইলিশ বিক্রি হয় তাও চাঁদপুরের মেঘনা ও বরিশারের সমুদ্র এলাকার মাছ। দাবি পদ্মার পাড়ের মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সাংবাদিকদের। কিন্তু, ভারতের গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে নেওয়া পদ্মার ইলিশ বিক্রি করছে কলকাতার মাছ ব্যবসায়ীরা। মাছ ব্যবসায়ীদের কু-ষড়যন্ত্রে বোকা হচ্ছেন দু’দেশের ভোজনরসিক ক্রেতারা। অন্যদিকে নিজেরা না পেলেও কলকাতার নাগরিকরা পদ্মার ইলিশ খাচ্ছেন খবর শুনে বেজায় চটছেন বাংলাদেশের নাগরিকরা। আর এটাকে পুঁজি করে ভারত বিরোধিতার পালে হাওয়া দিচ্ছেন বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থীরা। ইউটিউব-সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে ভারত বিরোধী বিদ্বেষ। ইলিশ নিয়ে পাকপন্থীদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশে বাড়ছে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ।ঐতিহ্যবাহী পদ্মার ইলিশ প্রাপ্তি নিয়ে বহুভাষী সংবাদ সংস্থা হিন্দুস্থান সমাচারের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কিশোর সরকারের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অজানা বহু তথ্য। এ ব্যাপারে হিন্দুস্থান সমাচারের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম, পদ্মা নদীর উপরে দীর্ঘ গবেষণা করা বাংলাদেশের একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের বার্তাসম্পাদক কল্যাণ সাহা এবং পদ্মার তীরের মাছ ব্যবসায়ী পাটুরিয়া ঘাটের মান্নান মৎস্য আড়তের মালিক আব্দুল মান্নান খান। হিন্দুস্থান সমাচার-এর সঙ্গে বার্তালাপে সাংবাদিক গবেষক কল্যাণ সাহা বলেন, বৈচিত্র্যময় জীবন ইলিশের। ইলিশ প্রধানত সামুদ্রিক মাছ হলেও প্রজননকালে ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য বেছে নেয় স্বাদু জলের উজানকে। এই সময়ে ইলিশ দৈনিক প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। এ লক্ষ্যে ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলসীমায় ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ থাকে। বাংলাদেশে ইলিশের অভয়াশ্রম রয়েছে ছয়টি (পাঁচটিতে মার্চ-এপ্রিল মাছ ধরা বন্ধ), যার মোট আয়তন ৪৩২ কিলোমিটার। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর এ ছয়টি অভয়াশ্রম রয়েছে। বাংলাদেশে ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্রের চারটি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যা প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এই চারটি পয়েন্ট হল- মীরসরাই, চট্টগ্রামের মায়ানি, তজুমুদ্দিন ও ভোলার পশ্চিমে সৈয়দ আওলিয়া, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজারের উত্তর কুতুবদিয়া এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়া ও লতাচাপালী। কিন্তু এতো কিছুর পরেও পদ্মা নদীতে ইলিশ নেই। মূলত প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলেও পদ্মা, মেঘনার মোহনায় অশংখ্য বালুচর পড়ে নদীর নাব্যতা কমে গিয়েছে। আর ইলিশ গভীর জলের মাছ। আর নদীতে অশংখ্য জালের কারণে উজানে ইলিশ তেমন আসার সুযোগ পায় না বলেই চলে। যে-কারণে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া পরে মেঘনা নদীতে কিছু পাওয়া গেলেও পদ্মায় ইলিশ মাছ মিলছে খুবই সামান্য।
তিনি বলেন, পদ্মার তীরে মাওয়া, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া গোয়লন্দ ঘাটে যে ইলিশ বিক্রি হয় তার ৯০ ভাগ চাঁদপুরের মেঘনা ও বরিশালের বিভিন্ন নদ-নদীর মোহানা ও সমুেদ্রর মাছ। তাই মাওয়া-পাটুরিয়া গোয়ালন্দ ফেরি ঘাটে এসে যারা পদ্মার ইলিশ ভেবে কিনছেন, তাঁরা অধিকাংশই বরিশালের বা চাঁদপুরের ইলিশ কিনছেন। আর যেখানে পদ্মা তীরের মানুষরাই পদ্মার ইলিশ পাচ্ছে না, সেখানে কলকাতার নাগরিকার পাবে কীভাবে। মূলত বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ভোজনরসিক মানুষদের কাছ থেকে অতিরিক্ত দাম নেওয়ার জন্যই এ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন, বলেছেন ‘বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ’। শুধু কলকাতা নয় মাছ ব্যবসায়ীদের চালবাজিতে প্রতারিত হচ্ছে উভয় দেশের ভোজনরসিক বাঙ্গালীরা। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরে গতবছর বর্ষা মৌসুমে রাজশাহীতে দু’কেজি ওজনের একটি ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল। এনিয়ে হুলুস্থূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে ফারাক্কা ক্রস করে ভারতের প্রায়াগরাজে গঙ্গায় ইলিশ নেয়ার ৩৬১ কোটি টাকার যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা মরুভূমিতে হাতি আমন্ত্রণ জানানোর মতো অবস্থা। পদ্মা নদীতে একেবারে ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছেনা এ কথা মানতে নারজ মাওয়া ঘাটের মৎস্য আড়তদার আব্দুল মান্নান খান। তিনি বলেন, ফরদিপুর থেকে পাবনা এলাকা পর্যন্ত পদ্মার প্রায় সব জেলেরা ইলিমসত সবধরণের মাছ মাওয়া ঘাটের আড়তগুলিতে নিয়ে আসে। বর্তমানে মাওয়ায় ৪০টি মাছের আড়তে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ কেজি পদ্মার ইলিশ আসে। তবে ভরা মৌসুমে অনেক সময় ৫ থেকে ৬ মন পদ্মার ইলিশ জেলেরা নিয়ে আসে। আবার চাঁদপুর ও বরিশালের ইলিশও পদ্মার বলে বিক্রি হয় বলে স্বীকার করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ঢাকাসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের পদ্মার ইলিশ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না সেখানে কলকাতা পদ্মার ইলিশ পাবে কোথা থেকে। তবে মান্নান বলেন, বাংলাদেশে মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা চলার সময় ভারতের পক্ষ থেকে মাছ ধরা বন্ধ রাখা উচিত। নাহলে নিষেধাজ্ঞা চলার সময় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ভারতের জেলেরা মাছ ধরেন এনিয়ে ক্ষোব বাড়ছে বাংলাদেশীদের মধ্যে।
বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রী শ.ম রেজাউল করিম বলেছেন, ইলিশ প্রজনন মৌসুমে একই সঙ্গে মাছধরা বন্ধ রাখলে উভয় দেশেই ইলিশের উৎপাদন বাড়বে। মাছধরা নিয়ে রাজনীতি করা বন্ধ হবে পাক-প্রেমীদের।