মুম্বাই, ৩ নভেম্বর : নাভি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে উজ্জ্বল আলোয় ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল ইতিহাসের নতুন দিগন্তে পদার্পণ করলো। হরমনপ্রীত কৌর শেষ ক্যাচটি তুলতেই তার সতীর্থরা মাঠে ছুটে গিয়ে আনন্দের কান্নায় ভাসলেন। প্রথমবারের মতো, ভারতীয় মহিলারা বিশ্বক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হলো। কিন্তু এই জয় শুধু একটি ক্রীড়া সাফল্য নয়, এর পেছনে একটি নীতির সফল বাস্তবায়ন রয়েছে, যা কয়েক বছর আগে একটি গোপন বোর্ড রুম বৈঠকে গৃহীত হয়েছিল।
২০২২ সালের অক্টোবর মাসে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) তাদের ১৫তম অ্যাপেক্স কাউন্সিল সভায় একটি বিপ্লবী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল—পুরুষ ক্রিকেটারদের মতো মহিলাদের ক্রিকেটারদেরও সমান ম্যাচ ফি দেওয়া হবে। এটি ছিল ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই এটির অর্থনৈতিক দিক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, কারণ মহিলা ক্রিকেট তখনও পুরুষ ক্রিকেটের মতো আয় আনে না। কিন্তু বিসিসিআই বিশ্বাস করেছিল যে সমান পারিশ্রমিকের সিদ্ধান্তই সফলতার পথ প্রশস্ত করবে।
শুরুর দিকে, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকরা নারী ক্রিকেটের পেছনে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে বিসিসিআইয়ের এই দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে সঠিক প্রমাণিত হয়। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে সকল সন্দেহকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে, এবং অবশেষে বিশ্বকাপ জয় করে সকলের মুখ বন্ধ করে দেয়।
বিশ্বকাপ জয়ের পেছনে শুধু খেলোয়াড়দের দক্ষতা এবং লড়াই ছিল না, এর পেছনে ছিল বিসিসিআইয়ের কঠোর পরিকল্পনা, যা ছিল এক অনন্য প্রক্রিয়া। বিসিসিআইয়ের সমান পারিশ্রমিক নীতি, ভালো প্রশিক্ষণ, এবং উইমেনস প্রিমিয়ার লিগ-এর মাধ্যমে মহিলাদের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছে। ডব্লিউপিএল ভারতীয় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলার সুযোগ দেয়, যা তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে।
এই জয় শুধু ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহত্তর সামাজিক বার্তা প্রদান করেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে, কেবল একজন তারকা খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর না করে, সঠিক অবকাঠামো, সমর্থন এবং সমান সুযোগের মাধ্যমে নারী ক্রীড়াবিদদের জন্যও চমৎকার ফল অর্জন সম্ভব। বিসিসিআইয়ের সমান পারিশ্রমিক নীতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিক এবং কাঠামোগত পরিবর্তনও এনে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে, ভারতীয় নারী ক্রিকেটাররা এখন তাদের খেলা নিয়ে আরও বেশি মনোযোগী, এবং সাফল্য অর্জন তাদের জন্য আরও সহজ হয়েছে।
ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের এই জয় শুধুমাত্র ভারতেই নয়, গোটা বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা ফুটবল দল, দীর্ঘদিন ধরে সমান পারিশ্রমিকের জন্য লড়াই করে আসছে। কিন্তু বিসিসিআইয়ের সিদ্ধান্ত এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেখিয়েছে যে সমান সুযোগ দেওয়া, কেবল বড় সাফল্যের পর নয়, বরং তার আগেই সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে করা যেতে পারে।
এই বিজয়টি ভারতীয় মহিলাদের ক্রীড়াজীবন এবং দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। মহিলাদের ক্রিকেট এখন আর একক তারকা খেলার নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠিত, সুরক্ষিত এবং সমান সুযোগের ভিত্তিতে বিকশিত একটি চ্যাম্পিয়ন দল। ভারতের নারী ক্রিকেট দলের এই বিশ্বকাপ জয় শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, এটি পুরনো প্রথা ভাঙার, সমান সুযোগ নিশ্চিত করার এবং সবার জন্য একটি সমতাভিত্তিক ক্রীড়াজগত প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত।
বিসিসিআইয়ের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এবং ভারতীয় মহিলাদের অবিশ্বাস্য সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী উদাহরণ তৈরি করেছে।

