আগরতলা, ১৭ অক্টোবর : গরু চুরির উদ্দেশ্যে ত্রিপুরায় প্রবেশে রাজ্যের দুই নাগরিককে আক্রমণের জেরে গণরোষে তিন বাংলাদেশী পাচারকারীর মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যের আক্রান্ত দুই নাগরিকের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা দুজনই পেশায় রাবার শ্রমিক। ওই ঘটনায় ভারত সরকারের কাছে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য ইতিমধ্যেই খোয়াই জেলা পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, ওই তিন বাংলাদেশী গরু চোরের কাছে দা ও বল্লম ছিল। পুলিশ ওই অস্ত্র উদ্ধার করেছে। তারা গরু চুরির উদ্দেশ্যেই অবৈধভাবে ত্রিপুরায় প্রবেশ করেছিল।
প্রসঙ্গত, ত্রিপুরার খোয়াই জেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এক গ্রামে গত বুধবার ১৫ অক্টোবর ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন বাংলাদেশী চোর নিহত হয়েছেন। নিহতরা গবাদি পশু চোরাকারবারির সঙ্গে যুক্ত বলে পুলিশ জানিয়েছে। সাথে আরো জানিয়েছে, ওই পাচারকারীরা দুই ভারতীয় গ্রামবাসীকে দা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে। তাদের মধ্যে মিঠুন তেলেঙ্গা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
খোয়াই জেলা পুলিশ সুপার রাণাদিত্য দাস জানিয়েছেন, খোয়াই জেলার চাম্পাহাওর থানার অন্তর্গত বিদ্যাবিল গ্রামের দুই বাসিন্দা সকালে সীমান্ত সংলগ্ন একটি রাবার বাগানে কাজ করতে যান। সেখানে তারা তিনজন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে লুকিয়ে থাকতে দেখতে পান। তারা গরু চুরির উদ্দেশ্যে সেখানে লুকিয়ে ছিল। সন্দেহজনক আচরণ দেখে স্থানীয়রা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে ওই তিনজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে। তাতে দুই গ্রামবাসী গুরুতর আহত হন।
পুলিশ সুপার জানান, আহতরা কোনোভাবে পালিয়ে গিয়ে গ্রামে পৌঁছে ঘটনার কথা জানান। এরপর ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা দল বেঁধে সীমান্ত এলাকায় ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তারা গরু চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিন বাংলাদেশীকে ধরে ফেলেন এবং গণরোষে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
খবর পেয়ে চাম্পাহাওর থানার পুলিশ ও ফরেনসিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনটি মৃতদেহ উদ্ধার করে খোয়াই জেলা হাসপাতালে পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য। আহত দুই ভারতীয় নাগরিককে বেহেলাবাড়ি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাদের জিবি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
খোয়াই জেলা পুলিশ সুপার জানান, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সিনিয়র অফিসাররা। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।
এদিকে, খোয়াই জেলার বিদ্যাবিল রাবার বাগান এলাকায় বুধবার নিহত তিন বাংলাদেশী চোরের মৃতদেহ বৃহস্পতিবার খোয়াই পহরমুড়া বাল্লারবের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এদিন দুপুরে বিএসএফ ও খোয়াই জেলা পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে দুই দেশের সীমান্ত কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃতদেহ হস্তান্তর সম্পন্ন হয়েছে।
নিহতরা হলেন, জুয়েল মিয়া (পিতা: মৃত আশরাফ উল্লা, গ্রাম: আলীনগর), পণ্ডিত মিয়া (পিতা: কনা মিয়া, গ্রাম: বাসুল্লা), সজল মিয়া (পিতা: কদ্দুস মিয়া, গ্রাম: কবিলাশপুর, ইউনিয়ন: গাজীপুর, বাংলাদেশ)।
উভয় দেশের সীমান্ত বাহিনীর উপস্থিতিতে শান্তিপূর্ণভাবে মৃতদেহ হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ঘটনাটি নিয়ে সীমান্ত এলাকায় আপাতত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও, ভবিষ্যতে অনুপ্রবেশ রুখতে বিএসএফ সতর্কতা আরও জোরদার করা প্রয়োজন বলে মতামত বিশেষজ্ঞ মহলের।
এদিকে, বাংলাদেশ সরকার গত ১৫ অক্টোবর ত্রিপুরায় তিনজন বাংলাদেশী নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
এক প্রেস বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার বলেছে, এই ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন। বাংলাদেশ সরকার এই নিন্দনীয় ঘটনার প্রতি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের সরকারকে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনার আহ্বান জানাচ্ছে এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা আবশ্যক।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, নাগরিকত্ব নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তি মানবাধিকার রক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা পাওয়ার অধিকার রাখেন, তারা সীমান্তের যে প্রান্তেই অবস্থান করুন না কেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকার বিবৃতি দিয়ে নিজ দেশের নাগরিকের মৃত্যুর নিন্দা এবং তদন্ত চেয়েছে। কিন্তু, বাংলাদেশী নাগরিক অবৈধভাবে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে ত্রিপুরায় এসে গরু চুরি করে পালানোর সময় দুই ভারতীয় নাগরিককে রক্তাক্ত করেছে, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য এবং তাদের অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম নিয়ে নিজ দেশে তদন্তের বিষয়ে কিছুই বিবৃতিতে উল্লেখ করেনি।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই তিন বাংলাদেশী নাগরিক সে-দেশে গরু পাচারকারী হিসেবেই পরিচিত। এমনকি, পাচারের সময় বাধা-বিপত্তি মোকাবেলায় তারা সব সময় নিজেদের সাথে দা, বল্লম ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়েই সীমান্ত অতিক্রম করেন। সেদিনও তারা সেই উদ্দেশ্যেই ত্রিপুরায় প্রবেশ করেছিল এবং গরু পাচারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাজ্যের দুই নাগরিককে রক্তাক্ত করেছে। তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

