বাংলাদেশে মাজারে হামলা, কবর খুঁড়ে পোড়ানো হলো বিতর্কিত পীরের দেহ, নিহত ১

জাকির হোসেন, ঢাকা, ৬ সেপ্টেম্বর: বাংলাদেশের রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা নামে বিতর্কিত এক পীরের মরদেহ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে নুরাল পাগলা আস্তানায়৷ এসময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত ও এক সাংবাদিক-সহ অন্তত শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত রাসেল মোল্লা গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের জতুমিস্ত্রীপাড়ার আজাদ মোল্লার ছেলে। রাসেল নুরাল পাগলের দরবারের ভক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে। ঘটনাস্থলে উপজেলা নির্বাহী আধিকারিকের (ইউএনও) গাড়ি ও পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। শুক্রবার জুমার নামাজের পর ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এই হামলার সূত্রপাত বলে খবর৷

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে দরবার শরিফ গড়ে তোলেন নুরুল হক। গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মারা যান নুরুল হক। ওই দিন রাতে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় আস্তানায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানায় স্থানীয় আলেম সমাজ।

এই ঘটনায় গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে নুরুল হকের আস্তানায় অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ করে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। তারা বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতলসহ বিভিন্ন দাবি জানায়। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে খবর, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী জুমার নামাজের পর আনসার ক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। কর্মসূচিতে একদল লোক শাবল, বড় হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়। তখন উপস্থিত আলেম–ওলামা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও ওই লোকজন মিছিল নিয়ে নুরুল হকের বাড়ির দিকে রওনা হয়। এ সময় পুলিশের দুটি গাড়ি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, মিছিল নিয়ে প্রথমে নুরুল হকের আস্তানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে উন্মত্ত জনতা। তখন দরবারের লোকজন ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলে অপর পাশ থেকেও ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়। একপর্যায়ে কয়েকশ লোক দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে দরবারে হামলা চালান। তখন ভক্তদের কয়েকজনকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং নুরুল হকের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। পরে নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত শতাধিক লোক আহত হন। পরে পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা আধিকারিক কৌশিক কুমার দাস বলেন, প্রত্যেকের শরীরে ইটপাটকেল, লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের কোপের আঘাতের চিহ্ন আছে। রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দরবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।

এদিকে নুরাল পাগলার কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার বলেছে, ‘এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত।’ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিবৃতি রাতে গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এ ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না।’ ‘কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জবাবদিহির ঊর্ধ্বে নয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

এই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশ আধিকারিক সেলিম বাদী হয়ে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর মামলাটি দায়ের করেন। শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) সকালে গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক তথা ওসি রাকিবুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে, রাজশাহীর পবা উপজেলায় একটি খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর করেছে একদল লোক। শুক্রবার উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের পানিশাইল চন্দ্রপুকুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুর রহমান ভান্ডারি প্রায় ১৫ বছর আগে বাড়ির পাশে নিজের জমিতে ওই খানকা শরিফ তৈরি করেন। তিনি তাঁর ভক্তদের কাছে ‘পীর’ হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ওই খানকাতে তিন দিনের আয়োজন ছিল। বৃহস্পতিবার থেকে আয়োজন শুরু হয়। সেখানে শিল্পীরা আসছিলেন, ভান্ডারি ও মুর্শিদী গান হচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে আগে থেকেই উত্তেজনা ছিল৷ জুমার নামাজের পর হামলার শঙ্কায় দুই গাড়ি পুলিশ নিয়ে সেখানে ছিলেন পবা থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মনিরুল ইসলাম। তবে হামলার সময় উত্তেজিত জনতাকে পুলিশ বাধা দেয়নি। হামলার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দেড় শতাধিক লোক খানকা শরিফে আক্রমণ করেন।

হামলার সময় বাড়ি থেকে বের হননি আজিজুর রহমান ভান্ডারি। তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে এলাকার কিছু লোক তাদের অনুষ্ঠানে বাধা দিচ্ছিলেন৷ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তাঁরা একত্র হয়ে খানকা শরিফে হামলা করেন। ভক্তরা তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেননি। তার বাড়ি লক্ষ্য করেও ইটপাটকেল ছোঁড়া হয়েছে।

পবা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গত রাতে থানায় অনেক মানুষ এসেছিল খানকার বিষয়ে। আমি সবাইকে শান্ত থাকতে বলেছিলাম। তারপরও উৎকণ্ঠা থাকায় পুলিশ গিয়েছিল। পুলিশ একটু দূরে ছিল। তখনই উত্তেজিত জনতা এটা করে ফেলে। মানুষ এত বেশি, অল্প কয়েকজন পুলিশের কিছুই করার ছিল না। এখন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তবে থানায় কোনো অভিযোগ করবেন না বলে জানিয়েছেন আজিজুর রহমান ভান্ডারি। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ছিল, ডিবি ছিল, ওসি নিজেই ছিলেন। সেখানে তাঁরা রক্ষা করেন না, অভিযোগ করব কার কাছে?’