ইম্ফল, ২৮ আগস্ট: মণিপুরে সম্প্রতি চালানো একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানে রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গি কার্যকলাপ, অস্ত্র চোরাচালান ও মাদক পাচারের বিরুদ্ধে বড়সড় সাফল্য অর্জন করেছে। গত দুই দিনে রাজ্যের বিভিন্ন অংশে পুলিশ, অসম রাইফেলস ও আধা-সামরিক বাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে একাধিক জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য, মাদক পাচারকারী, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও এক ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত। সেই সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক, ইয়াবা ট্যাবলেট, হেরোইন, ব্রাউন সুগার ও নগদ টাকা, যা রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি।
এই ধারাবাহিক অভিযানের শুরু হয় ২৬ আগস্ট, যখন ইম্ফল ওয়েস্ট জেলার সিংজামেই থানার অধীনস্থ চাঞ্চিপুর এলাকায় গ্রেফতার করা হয় ২৩ বছর বয়সী সুরজ ওইনাম ওরফে চিন্খোম্বা ও আবুঙ্গোকে, যে কাংগ্লেইপাক কমিউনিস্ট পার্টি-এর সক্রিয় সদস্য। সে দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিল লামশাং মায়াই লাইকাই এলাকায়। পরদিন, ২৭ আগস্ট ইম্ফল ইস্ট জেলার থৌবাল ড্যাম থানার অন্তর্গত ইথাম ওয়াংমা মায়াই লাইকাই গ্রামে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় কাংলেই ইয়াওল কান্না লুপ-এর ২২ বছর বয়সী সদস্য সরংথেম ইবোমচা মেইতৈ ওরফে লুয়াংবাকে। তার কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়েছে, যা তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। একই দিনে, মোরে শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে গ্রেফতার করা হয় ভি শিবা ওরফে ঈশ্বর পাণ্ডেকে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে জোর করে টাকা তুলছিলেন এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত হয়ে অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই অভিযানে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়েছে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল প্রমাণ থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযুক্তকে পরবর্তী তদন্তের জন্য কাকচিং জেলার প্যালেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
২৭ আগস্ট কাংপোকপি থানার আওতাধীন মাওহিং ও চাংওবাং গ্রামের মধ্যবর্তী জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র, যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন তৈরি M16 রাইফেল, ম্যাগাজিন, গুলি, লুন্ঠিত .303 রাইফেল, লাইট মেশিনগানের যন্ত্রাংশ, একাধিক বিদেশি ও দেশি পিস্তল, গ্রেনেড, রেডিও সেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস। এছাড়াও সেকমাই থানার খোংনাংপোকপি ও নিউ কেইথেলমানবি থানার কটজিম এলাকার সংলগ্ন অঞ্চলে তল্লাশিতে উদ্ধার হয় দেশি তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র, কারবাইন, গ্রেনেড এবং ইম্প্রোভাইজড মর্টার। এই বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার উদ্ধারের ফলে স্পষ্ট, রাজ্যে এখনও সক্রিয় রয়েছে একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী, যারা সীমান্ত অঞ্চলকে ব্যবহার করছে অস্ত্র ও সন্ত্রাস ছড়ানোর কাজে।
মাদক পাচার বিরোধী অভিযানে ২৬ আগস্ট চুরাচাঁদপুর জেলার বেহিয়াং ও বুয়ালকোট গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় পাঁচজন পাচারকারীকে — কাইগুনলাল হাউকিপ (২২), ডালজাগিন (৪৭), সাইগৌলাল হাউকিপ (৩২), থাংখোহাও (৩৪) ও স্যামুয়েল (৩০)। তাদের কাছ থেকে ৭২৮ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়, যা ৫৬টি সাবান কেসে রাখা ছিল। তিনটি গাড়িও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে — একটি বোলেরো, একটি স্কুটার ও একটি পালসার বাইক। পরদিন সেনাপতি জেলার মার্টায়ার্স পার্ক এলাকায় গ্রেফতার করা হয় মোঃ ইউনুস খান (৩১)-কে, যার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে ২.২ কেজি ওজনের ডব্লিউওয়াই ট্যাবলেটের ৯২টি প্যাকেট। এ সময় একটি টাটা উইঙ্গার গাড়িও আটক করা হয়। থৌবাল জেলায় মাদক বিরোধী অভিযানে ধরা পড়ে মোঃ আজাদ খান (৩২), যার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ৯০০ মিলি কোডিন সিরাপ, ১২ গ্রাম ব্রাউন সুগার, ২০ গ্রাম মেথামফেটামিন এবং নগদ ১,৪৬,৫৫০ টাকা।
এর আগেই ইম্ফল ওয়েস্ট জেলার ওল্ড লম্বুলানে এলাকায় জেল রোডের কাছে ধরা পড়ে দুই পাচারকারী — এস. দাবিহাই মিক্রি (২১) ও এনগাওলোনি (৪৮)। তাদের কাছ থেকে ৩০টি সাবান কেসে রাখা ৩৪১ গ্রাম ব্রাউন সুগার উদ্ধার হয়। মাদক উদ্ধার অভিযানের এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, মণিপুর এখনো আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান রুটের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এর পাশাপাশি, ১৭ মে নাগমজু গ্রামে সংঘটিত ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের মামলায় কৃরিদিজিপি গ্রামের ৩৫ বছর বয়সী নেপুনি-কে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই মামলায় এটি দ্বিতীয় গ্রেফতার হলেও আরও একজন অভিযুক্ত এখনও পলাতক রয়েছে।
সর্বশেষে, ২৬ আগস্ট টেনগনৌপাল জেলার মোরে শহরের সন্নিকটে হাওলেনফাই এলাকায় অসম রাইফেলস, স্থানীয় পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর যৌথ অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে এক সন্দেহভাজন অপরাধীকে, যার বিরুদ্ধে অস্ত্র পাচার ও তোলাবাজির অভিযোগ রয়েছে। ওই ব্যক্তি ভিলেজ ভলান্টিয়ার্স ইস্টার্ন জোন নামক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অভিযান চলাকালীন উদ্ধার হয়েছে একটি মোবাইল ফোন, যা থেকে চোরাচালান ও তোলাবাজির নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
এই পরপর সফল অভিযানে মণিপুর পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা রাজ্যের সন্ত্রাস, মাদক এবং অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে সদা তৎপর এবং সক্রিয়। যদিও পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, এই পদক্ষেপগুলি জনসাধারণের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়েছে এবং প্রশাসনের উপর আস্থা জোগাচ্ছে। তবু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অনুপ্রবেশ, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান রুখতে ভবিষ্যতেও আরও কঠোর নজরদারি ও যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

