রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবে ভারতের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে: মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট

ওয়াশিংটন, ২৫ আগস্ট: রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বন্ধে অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ভারতের উপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তাঁর মতে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন “আক্রমণাত্মক অর্থনৈতিক কৌশল” গ্রহণ করেছে, যার অংশ হিসেবে ভারতকে লক্ষ্য করে এই শুল্ক বসানো হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই—রাশিয়ার তেলভিত্তিক অর্থনীতিকে দুর্বল করা এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য মস্কোর উপর চাপ বৃদ্ধি।

এনবিসি নিউজের জনপ্রিয় টক শো “মিট দ্য প্রেস”-এ একান্ত সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেন, “ট্রাম্প যে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করেছেন, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভারতের উপর আরোপিত সেকেন্ডারি ট্যারিফ। এর মাধ্যমে তিনি রাশিয়াকে বার্তা দিতে চেয়েছেন যে, তারা যদি ইউক্রেনে হত্যা ও ধ্বংস বন্ধ করে, তবে আবারও বিশ্ব অর্থনীতির অংশ হতে পারে। কিন্তু যদি তা না করে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তারা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।”

ভ্যান্স জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্টায় রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের পক্ষ থেকেই সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কিছু “গুরুত্বপূর্ণ ছাড়” দেখা গেছে। এই ছাড়গুলিকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির পথ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।

“আমরা আশাবাদী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে এই বার্তাই স্পষ্টভাবে দিয়েছেন,” বলেন ভ্যান্স।

এই বছরের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে যে, ভারতের বেশ কয়েকটি রফতানি পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হবে। এর মধ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক শুধুমাত্র ভারত রাশিয়া থেকে ছাড়মূল্যে অপরিশোধিত তেল কেনে বলেই বসানো হয়েছে।

ভারতের এই তেল কেনা নিয়ে আমেরিকার অভিযোগ—এই লেনদেন রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতিকে সমর্থন করছে। যদিও ভারত তা সরাসরি অস্বীকার করেছে। নয়াদিল্লির মতে, দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ও বাজারের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করেই তেল ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তখন থেকেই ভারত, অন্যান্য অনেক দেশের মতো, ছাড়মূল্যে রাশিয়ান তেল আমদানির দিকে ঝুঁকেছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “একটি প্রো-বিজনেস মার্কিন প্রশাসনের লোকজন যখন আমাদের ব্যবসা নিয়ে অভিযোগ করেন, তখন সেটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ব্যবসা যদি আপনার না-পসন্দ হয়, তবে আপনি সেটা করবেন না। কিন্তু আপনি তো নিজেও সেই তেল কিনছেন।”

তিনি আরও বলেন, “আপনার যদি ভারতের কাছ থেকে পরিশোধিত তেল বা পেট্রোলিয়াম পণ্য কেনা নিয়ে সমস্যা থাকে, তবে কিনবেন না। কেউ তো জোর করে বিক্রি করছে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ কিনছে, আমেরিকাও কিনছে। আপনি যদি আপত্তি করেন, তবে নিজেই কেনা বন্ধ করুন।”

বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে এই কারণে যে, রাশিয়ার তেলের বৃহত্তম ক্রেতা চীন এবং রাশিয়ার গ্যাস আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে ইউরোপ। অথচ ভারতের ক্ষেত্রে যেমন প্রকাশ্যে সমালোচনা ও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, তেমনি দৃষ্টিভঙ্গি চীন ও ইউরোপের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

নির্বাচনের মুখে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দিক থেকেও একটি কৌশল হতে পারে, এমন ইঙ্গিতও দিচ্ছেন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে এমন একটি বার্তা দিতে, যেখানে আমেরিকা যুদ্ধ থামাতে দৃঢ় এবং নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখেই বিশ্ব রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে চায়।

বিশ্ব মঞ্চে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন মধ্যস্থতা সফল হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ভারতকে লক্ষ্য করে ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক নীতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক দিয়েও ভবিষ্যতে আরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে—এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।