ভারতজুড়ে বর্ষার তাণ্ডব: বিক্রোলিতে ভূমিধসে মৃত্যু ২ জনের, হিমাচল প্রদেশে মৃত ২৫৭; মুম্বাই, রায়গড়, লাতুরে জারি লাল সতর্কতা

মুম্বাই, ১৬ আগস্ট : শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাত মুম্বাইয়ের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে শহরের একাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ভারী বৃষ্টির ফলে পূর্ব উপনগর বিক্রোলির ভার্ষা নগরে ভূমিধসের ঘটনা ঘটে, যাতে প্রাণ হারান দুই ব্যক্তি। ভারতীয় আবহাওয়া দফতর মুম্বাইয়ের জন্য শনিবার ও রবিবার দুই দিনের লাল সতর্কতা জারি করেছে। পাশাপাশি রায়গড়, ঠাণে, লাতুর, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা ও হিমাচল প্রদেশে বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা।

শনিবার ভোর ২টা ৩৯ মিনিট নাগাদ বিক্রোলি পার্কসাইট এলাকার ভার্ষা নগরে একটি পাহাড়ি ঢাল থেকে মাটি ও পাথর গড়িয়ে পড়ে একটি কুঁড়ে ঘরের উপর। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৯ বছর বয়সি শালু মিশ্র ও ৫০ বছর বয়সি সুরেশ মিশ্র। আহত হয়েছেন আরতি মিশ্র (৪৫) এবং রুতুরাজ মিশ্র (২০), যাঁদের রাজাওয়াড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে।

বৃহন্মুম্বই পৌর নিগম সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত ওই বসতিতে ভূমি ধসে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনা ঘটার পরপরই স্থানীয় পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড ও বিপর্যয় মোকাবিলা দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধারকাজ শুরু করে।

IMD সূত্র অনুযায়ী, শনিবার সকাল ৮:৩০ পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘণ্টায় মুম্বাইয়ের সান্তাক্রুজে ২৪৫ মিমি এবং কোলাবা স্টেশনে ৮৩.২ মিমি বৃষ্টি রেকর্ড হয়েছে। বিক্রোলিতে সর্বোচ্চ ২৫৭.৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে, যেখানে ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। অন্যান্য এলাকার মধ্যে সায়নে ২২৮ মিমি, জুহুতে ২১৯.৫ মিমি, বান্দ্রায় ১৮৪ মিমি ও বাইকুল্লায় ১৭২ মিমি বৃষ্টি হয়েছে।

এই বৃষ্টিপাত আগস্ট মাসে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে ২০২০ সালের পরে। ২০২০ সালের ৪ আগস্ট সান্তাক্রুজ স্টেশনে ২৬৮.৬ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।

শনিবার থেকেই মুম্বইয়ে শুরু হয়েছে জন্মাষ্টমীর দই-হাঁড়ি উৎসব। এমন সময় প্রবল বর্ষণ ও ভূমিধসের কারণে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। শহর জুড়ে জলাবদ্ধতা ও ট্রাফিক জ্যাম সাধারণ মানুষের চলাচল ব্যাহত করেছে।

প্রবল বর্ষণের জেরে লাতুর জেলার টেরনা ও মাঞ্জারা নদীর জলস্তর বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। শনিবার সকালে টেরনা বাঁধের ১০টি গেট ১০ সেন্টিমিটার করে খুলে দেওয়া হয়, ফলে ৩৮০৬.৫৬ কিউসেক জল ছাড়া হয়। দুপুরে ছয়টি গেট বন্ধ করে চারটি গেট দিয়ে ১৫২২.৫৬ কিউসেক হারে জল ছাড়া হচ্ছে।

মাঞ্জারা নদীর উৎস বিড জেলার গাভালওয়াড়ি গ্রামে এবং তা দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হয়ে তেলেঙ্গানার গোধাবরী নদীতে মিশেছে। মাঞ্জারা বাঁধ বর্তমানে ৮৭ শতাংশ পূর্ণ হয়েছে, যা এলাকা জুড়ে প্লাবনের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।

হায়দরাবাদ আবহাওয়া কেন্দ্র থেকে শনিবার দুপুরে জারি করা বুলেটিন অনুযায়ী, আদিলাবাদ ও নির্মল জেলায় আগামী কয়েক ঘণ্টায় হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। দক্ষিণ ছত্তীসগঢ় ও সংলগ্ন এলাকায় নিম্নচাপের ফলে মাটি সম্পূর্ণরূপে জলসিক্ত হয়ে গেছে, ফলে হালকা বৃষ্টিপাতেও প্লাবনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই সতর্কতা শনিবার বিকেল ৫:৩০ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

আবহাওয়া দফতরের মতে, রাজস্থানের উদয়পুর ও জোধপুর বিভাগে আগামী কয়েক দিন মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও কোট, আজমের, জয়পুর, ভরতপুর ও বিকানের বিভাগে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে ধারাবাহিকভাবে নিম্নচাপ তৈরি হওয়ায় আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে সক্রিয় বর্ষা চলবে বলে জানানো হয়েছে।

ওড়িশার দক্ষিণ জেলা কোরাপুট ও মালকানগিরিতে ভারী বৃষ্টির ফলে ভূমিধস ও রাস্তা জলমগ্ন হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত। মালকানগিরির এমভি-৯৬ গ্রামে জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে তিন ফুট জল বইছে, যার ফলে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের মধ্যে আন্তঃরাজ্য যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বহনকারী ট্রাকগুলি রাস্তায় আটকে পড়েছে।

হায়দরাবাদ শহরে শনিবারের জন্য আবহাওয়া দফতর কমলা সতর্কতা জারি করেছে। দিনভর আকাশ মেঘলা থাকবে এবং মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত, বজ্রপাত ও দমকা হাওয়া বইতে পারে বলে পূর্বাভাস।

দিল্লিতে শনিবার সকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.৫ ডিগ্রি কম। আবহাওয়া দফতরের মতে, শহরে আংশিক মেঘলা আকাশ ও হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। শনিবার ও রবিবার তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রির আশপাশে থাকবে।

হিমাচল প্রদেশে চলতি বর্ষা মরসুমে ২০ জুন থেকে শনিবার পর্যন্ত মোট ২৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ভূমিধস, প্লাবন, ডুবে যাওয়া ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো বর্ষাজনিত দুর্ঘটনায় এবং ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এ ছাড়া ৩৩১ জন আহত এবং ৩৭ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

ভারতজুড়ে প্রবল বর্ষা ও তার জেরে সৃষ্ট দুর্যোগে বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সংখ্যা। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে একাধিক নিম্নচাপের প্রভাবে আগস্টের শেষ পর্যন্ত ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সাধারণ মানুষকেও পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক ও প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।