“প্যারিস যখন কুকুর হত্যা করেছিল”: সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ঘিরে মেনকা গান্ধীর তীব্র প্রতিক্রিয়া, ইতিহাস টেনে দিলেন সতর্কবার্তা

নয়াদিল্লি, ১২ আগস্ট :দিল্লি ও আশেপাশের এলাকা থেকে সমস্ত রাস্তার কুকুরকে অপসারণ করে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করার সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে চরম বিতর্ক ও উদ্বেগ। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, পশু অধিকার কর্মী ও বিজেপি নেত্রী মেনকা গান্ধী। তিনি এই আদেশকে একদিকে যেমন “অবাস্তব” ও “অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব” বলে দাবি করেছেন, তেমনই এর ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে বড়সড় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেছেন।

গত সোমবার, দেশের শীর্ষ আদালত একটি মামলার শুনানিতে দিল্লি, গুরুগ্রাম, নয়ডা এবং গাজিয়াবাদের রাস্তাগুলি থেকে সমস্ত স্ট্রে বা পথকুকুরকে অবিলম্বে অপসারণ করে সরকারি বা বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেয়। আদেশে বলা হয়, জননিরাপত্তা ও নাগরিকের জীবনযাত্রার মান রক্ষার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

আদালতের মতে, পথকুকুরদের আচরণ অনেক সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের জন্য। তাই অবিলম্বে এদের সরিয়ে নেওয়া উচিত। তবে এই নির্দেশিকায় প্রাণীপ্রেমী ও পশু অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনগুলির মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে “ভুল দৃষ্টিভঙ্গির ফল” বলে অভিহিত করে মেনকা গান্ধী বলেন, “দিল্লি থেকে কুকুর সরিয়ে দিলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গাজিয়াবাদ, ফরিদাবাদ থেকে লাখ লাখ কুকুর আবার এই শহরে চলে আসবে। কারণ খাবার এখানে। আর কুকুর না থাকলে অন্য প্রাণীরা, যেমন বানর বা ইঁদুর, রাস্তা দখল করে নেবে। আমি এটা আমার নিজের বাড়িতে দেখেছি।”

তিনি আরো বলেন, কুকুর শুধুমাত্র মানুষের সঙ্গী নয়, তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ পৃথিবীব্যাপী পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রাণী। কুকুর রাস্তায় থাকলে ইঁদুরের মতো ছোঁয়াচে রোগ বহনকারী প্রাণী নিয়ন্ত্রিত থাকে।

মেনকা গান্ধী তাঁর বক্তব্যকে জোরদার করতে ইতিহাসের দিকে নজর ঘুরিয়ে বলেন: “১৮৮০-এর দশকে প্যারিস প্রশাসন রাস্তার কুকুর ও বিড়ালদের সরিয়ে দেয়। কারণ তারা মনে করেছিল এই প্রাণীরা জলাতঙ্ক ও রোগ ছড়ানোর কারণ। কিন্তু ফলাফল কী হয়? পুরো শহর ইঁদুরে ভরে যায়।”

প্যারিসের রাস্তায় একসময় ঘুরে বেড়াত অসংখ্য কুকুর। শহর আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ও স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে এই কুকুরদের হত্যা বা অপসারণ করা হয়। গবেষণাপত্র ‘স্ট্রে ডগস অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ মডার্ন প্যারিস’-এ বলা হয়েছে, ১৮৮৩ সালে ফার্মাসিস্ট এমিল ক্যাপরনের নেতৃত্বে রাস্তার কুকুরদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। কারণ তারা ঘোড়াকে ভয় দেখিয়ে রাস্তায় দুর্ঘটনার সৃষ্টি করত।

যদিও এই সময়ে বিড়ালদের গণহত্যার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে রবার্ট ডার্নটনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দ্য গ্রেট ক্যাট ম্যাসাকার’-তে ১৭৩০ সালের একটি বিড়াল নিধনের ঘটনা উল্লেখ আছে, যেখানে ছাপাখানার শ্রমিকরা প্রতিবাদ স্বরূপ বহু বিড়াল হত্যা করে।

মেনকা গান্ধীর মতে, রাস্তায় কুকুর থাকা মানে শুধু “উপদ্রব” নয়, বরং শহরের এক অংশে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কুকুর যেমন ইঁদুর, সাপ, চোরকে তাড়ায়, তেমনই তারা আবর্জনার উপরে নির্ভর করেও শহরের পরোক্ষ সাফাইয়ে সাহায্য করে।

তিনি আরও বলেন, “যদি আপনি লাখ লাখ কুকুরকে একসাথে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠাতে চান, তাহলে কেবল অর্থনৈতিক চাপই নয়, প্রাণীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিক থেকেও এটা নির্মম সিদ্ধান্ত।”

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু দিল্লিতেই আনুমানিক ৬-৮ লক্ষ রাস্তার কুকুর রয়েছে। এদের স্থানান্তর ও পরিচর্যার জন্য যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা বর্তমানে সরকারের কাছে নেই বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পশু চিকিৎসক, খাদ্য, জায়গা, পরিচর্যার ব্যবস্থা করা ছাড়াও প্রয়োজন হবে বিপুল জনবল ও তহবিল।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে বিশদ পরিকল্পনা জানানো হয়নি। প্রাণী কল্যাণ বোর্ড, এনজিও ও স্থানীয় পুরসভাগুলির সমন্বয়ে কীভাবে এই নির্দেশ কার্যকর হবে, সে প্রশ্নও উঠে এসেছে।

সুপ্রিম কোর্টের রায় মানবিক নিরাপত্তা ও নাগরিক সুবিধার কথা ভেবে দেওয়া হলেও, তার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু প্রশ্ন। মেনকা গান্ধীর মতো বহু প্রাণীপ্রেমী নেতার মতে, এই সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত এবং তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে আরও বিপজ্জনক।