‘‘কে প্রকৃত ভারতীয়, তা ঠিক করার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের নয়’’-প্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা নিয়ে সরব প্রিয়াঙ্কা গান্ধী

নয়াদিল্লি, ৫ আগস্ট : সুপ্রিম কোর্টে রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে চলমান মামলার শুনানির সময় বিচারপতিদের করা একটি পর্যবেক্ষণ ঘিরে রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের ঝড়। সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ রাহুল গান্ধীর ২০২২ সালের “চীন অধিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ড” সংক্রান্ত মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং বলেন, ‘‘আপনি যদি একজন প্রকৃত ভারতীয় হন, তাহলে এমন কথা বলতেন না।’’

এই পর্যবেক্ষণকে ঘিরে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিক্রিয়া দেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র। তিনি বলেন, “মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি আমার যথাযথ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু কে একজন প্রকৃত ভারতীয়, তা নির্ধারণ করার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের নয়। একজন বিরোধী নেতার কাজ হল সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা। রাহুলজি কখনওই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলেন না, বরং তিনি তাঁদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। তাঁর বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।”

২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সময় রাহুল গান্ধী এক সাংবাদিক সম্মেলনে চীন প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“চীন ২০০০ বর্গকিমি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করেছে, আমাদের ২০ জন জওয়ান শহিদ হয়েছেন, এবং অরুণাচল প্রদেশে চীনের সেনারা আমাদের সৈনিকদের মারধর করছে। কিন্তু কেউ এই বিষয়গুলি নিয়ে সরকারকে প্রশ্ন করছে না। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমও চুপ। এটা কি সত্যি নয়?”

এই মন্তব্যের পর উত্তরপ্রদেশের লখনউ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে সমন জারি করে আদালত। রাহুল গান্ধী এরপর এলাহাবাদ হাইকোর্টে আবেদন করেন সমন খারিজের জন্য, কিন্তু সেখান থেকে তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান।

সোমবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত এবং বিচারপতি এজি মাসিহের বেঞ্চ লখনউ আদালতের মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। তবে সেইসঙ্গে তাঁরা রাহুল গান্ধীকে ভর্ৎসনা করে বলেন,“আপনি বিরোধী দলের নেতা, সংসদে বলার জন্য আপনার একটি নির্দিষ্ট মঞ্চ রয়েছে। তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কথা কেন বলছেন? কীভাবে জানলেন ২০০০ বর্গকিমি জমি দখল হয়েছে? আপনি যদি সত্যিকারের ভারতীয় হন, তাহলে এমন মন্তব্য করা উচিত নয়।”

বেঞ্চ আরও বলেন, ‘‘সেনাদের ‘থ্রাশ’ বা মারধর করার মতো শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয়, বিশেষ করে এমন একজন নেতার পক্ষে, যিনি দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের মুখ।’’

সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণের পর কংগ্রেসের তরফ থেকে একের পর এক নেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কংগ্রেস সাংসদ কেসি বেণুগোপাল বলেন, “রাহুল গান্ধী যা বলেছেন, তা প্রতিটি দেশপ্রেমিক ভারতীয়ের মনের কথা। আমরা যখন সংসদের ভিতরে প্রশ্ন করি, কোনও উত্তর দেওয়া হয় না। আবার বাইরে প্রশ্ন তুললে আমাদের দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়। আজকাল সত্য কথা বললেই দেশদ্রোহী বলা হয়। তাহলে কে ঠিক করবে কে প্রকৃত ভারতীয়? আমরা সেই ভারতীয়, যারা দেশের স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে।”

কংগ্রেস নেতাদের মতে, দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধী নেতারা সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। প্রশ্ন তোলা গণতন্ত্রের ভিত্তি, এবং তা রুদ্ধ করতে চাওয়াই প্রকৃতপক্ষে দেশবিরোধী মনোভাব।

রাহুল গান্ধী এখনও এই বিষয়ে কোনও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া দেননি, তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, তিনি নিজের বক্তব্যে অনড়। তিনি মনে করেন, চীন সীমান্ত ইস্যুতে সরকার প্রকৃত তথ্য গোপন করছে এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তাঁর মতে, ভারতের ভূখণ্ড চীন দখল করেছে—এই সত্যটি স্বীকার না করে সরকার ‘দেশপ্রেম’-এর আড়ালে সমালোচনাকে স্তব্ধ করতে চাইছে।

সুপ্রিম কোর্টে মামলার পরবর্তী শুনানি কবে হবে, তা এখনও নির্ধারিত নয়। তবে এই ঘটনা যে আগামী দিনে সংসদে এবং দেশের রাজনৈতিক ময়দানে বিরোধ ও বিতর্ককে আরও উসকে দেবে, তা নিশ্চিত। ‘প্রকৃত ভারতীয়’ কে—এই প্রশ্ন আপাতত ভারতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।