নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর কৌশলগত ব্যর্থতার জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের করিডর সংকট: হিমন্ত বিশ্ব শর্মা

নয়াদিল্লি, ২৫ মে : অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নীতি আয়োগের ১০ম গভর্নিং কাউন্সিল বৈঠকে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর “কৌশলগত ব্যর্থতা”কে দায়ী করলেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি নিরাপদ ভূ-প্রবেশ করিডরের অভাবের জন্য।

তিনি অভিযোগ করেন, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নেহরু চট্টগ্রামকে ভারতের অংশ করে তুলতে ব্যর্থ হন এবং ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি বিস্তৃত ও সুরক্ষিত করিডর প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ হারিয়ে ফেলেন।

হিমন্ত বলেন, স্বাধীনতার আগে অসম ছিল এক সমৃদ্ধ অঞ্চল, যার মাথাপিছু আয় জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি ছিল। তৎকালীন সময়ে ডিব্রুগড় থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেল সংযোগ ছিল এবং ব্রহ্মপুত্র নদ ব্যবহার করা হতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে, যা অসমকে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বন্দর শহরের সঙ্গে যুক্ত করত।

“কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এই সব সংযোগ রাতারাতি বিচ্ছিন্ন করে দেয়,” বলেন তিনি। “অসমকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে শুধু সংকীর্ণ ও দুর্বল সিলিগুড়ি করিডর, যেটি আজ ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত।”

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস অঞ্চলের ৯৭ শতাংশ মানুষ অ-মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও, সেই অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) অংশ করা হয়। এমনকি ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এ রাঙামাটিতে চাকমা নেতারা ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন ভারতভুক্তির আশায়, কিন্তু নেহরু তাতে হস্তক্ষেপ করতে রাজি হননি।

“নেহরুর এই নীরব সম্মতি আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৈশ্বিক বাণিজ্য থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একই রকম একটি সুযোগ এসেছিল ১৯৭১ সালে, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীও তখন করিডর চুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ কৌশল নেননি,” মন্তব্য করেন মুখ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এই সব মুহূর্তে সাহসী নেতৃত্ব থাকলে উত্তর-পূর্ব ভারতের ভৌগলিক এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যত ভিন্ন হতে পারত।

তবে আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর “দূরদর্শী নেতৃত্বে” এই অঞ্চল আর ইতিহাসের বন্দী নয় বলে দাবি করেন তিনি। বর্তমানে অসম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল ‘বিকশিত ভারতের’ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে।

“আমরা জলপথ পুনরুজ্জীবিত করছি, রেল যোগাযোগ ও অবকাঠামো নির্মাণ করে এই অঞ্চলকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে তুলছি,” বলেন তিনি।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রকৃত সম্ভাবনা খুলে দিতে হলে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যে নীতিগত পদক্ষেপগুলোর উপর জোর দেন সেগুলো হল— বিশেষ ট্রান্সপোর্ট ও লজিস্টিক করিডর, জলপথ ও রেল পরিকাঠামোর পুনরুজ্জীবন, শিল্পের জন্য ভর্তুকি ও ইনসেনটিভ, এবং সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, “উত্তর-পূর্ব ভারত প্রান্তিক নয়—এটি একটি কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সীমান্ত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবে আমাদের এই অঞ্চল সমৃদ্ধ মানবসম্পদ এবং সম্ভাবনায় পূর্ণ।”

সম্প্রতি চীনে এক সফরের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস মন্তব্য করেন, “ভারতের সাতটি রাজ্য, যাদের ‘সেভেন সিস্টারস’ বলা হয়, তারা স্থলবেষ্টিত। সমুদ্রে তাদের কোনও প্রবেশাধিকার নেই। আমরাই এই অঞ্চলের একমাত্র সামুদ্রিক গার্ডিয়ান।”

তিনি আরও বলেন, “এটি চীনের অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণের সম্ভাবনা তৈরি করে।” ইউনুসের এই মন্তব্য উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

পরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেন, “ভারতের ৬,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। বিমসটেক অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে ভারতের সীমানা রয়েছে এবং এই উপমহাদেশ ও এসিয়ান অঞ্চলের সংযোগ রক্ষায় ভারত একটি প্রধান ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন বিমসটেক সংযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।”