‘এক দেশ এক নির্বাচন’ সুশাসনকে নতুন মাত্রা দেবে, জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেন রাষ্ট্রপতি

নয়াদিল্লি, ২৫ জানুয়ারি : এক দেশ এক নির্বাচন সুশাসনকে নতুন মাত্রা এনে দেবে। শাসন ব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি করবে, নীতি নির্ধারণে জড়তা দূর হবে। ৭৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের প্রাক সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে একথা বলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। সাথে তিনি যোগ করেন, আমাদের সংবিধান জীবন্ত দলিল। 

এদিন তিনি বলেন, ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমাদের সংবিধান সভার কাঠামোতেও প্রতিফলিত হয়। সেই সভায় দেশের সকল অংশ এবং সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সংবিধান সভায় সরোজিনী নাইডু, রাজকুমারী অমৃত কৌর, সুচেতা কৃপালানি, হংসবেন মেহতা এবং মালতী চৌধুরীর মতো ১৫ জন অসাধারণ বিদূষীও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যখন বিশ্বের অনেক অংশে নারীর সমতাকে একটি দূরবর্তী আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হত, তখন ভারতের মহিলারা জাতির ভাগ্য গঠনে সক্রিয়ভাবে অবদান রাখছিলেন।

তাঁর কথায়, আমাদের সংবিধান একটি জীবন্ত দলিল হয়ে উঠেছে, কারণ নাগরিকদের নিষ্ঠা, কয়েক শতাব্দী ধরে আমাদের জীবনের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রীয় উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের সংবিধান ভারতীয় হিসেবে আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি এবং আমাদের একটি পরিবার হিসেবে ঐক্যসূত্রে গাঁথে। গত ৭৫ বছর ধরে, সংবিধান আমাদের অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করে তুলেছে। আজকের দিনে, আমরা সংবিধান সভার খসড়া কমিটির অধ্যক্ষ ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর, সভার অন্যান্য বিশিষ্ট সদস্য, সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, যাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ আমরা এই অসাধারণ গ্রন্থটি পেয়েছি, বলেন তিনি।

তাঁর বক্তব্য, সংবিধান বাস্তবায়ন পরবর্তী ৭৫ বছরে আমাদের তরুণরা সাধারণতন্ত্রের সর্বাত্মক অগ্রগতির সাক্ষী থেকেছেন। স্বাধীনতার সময় এবং তার পরেও, দেশের বিশাল অংশে চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধার পরিস্থিতি অব্যাহত ছিল। কিন্তু, আমাদের আত্মবিশ্বাস কখনও হ্রাস পায়নি। আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করার সংকল্প নিয়েছি যেখানে প্রত্যেকেরই উন্নয়নের সুযোগ থাকবে। তিনি বলেন, আমাদের কৃষক ভাই-বোনেরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং আমাদের দেশকে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন। আমাদের শ্রমিক ভাই-বোনেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এবং আমাদের পরিকাঠামো এবং নির্মাণ ক্ষেত্রকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তাঁদের অসাধারণ কর্মদক্ষতার ফলে আজ ভারতীয় অর্থনীতি বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। আজকের ভারত, বিবিধ আন্তর্জাতিক মঞ্চে নেতৃত্বের স্থান অর্জন করছে। সংবিধানে বর্ণিত রূপরেখা ছাড়া এই ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব হত না।

তাঁর কথায়, আমরা ১৯৪৭ সালেই স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু ঔপনিবেশিক মানসিকতার অনেক অবশিষ্টাংশ দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে, আমরা সেই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। এই ধরণের প্রচেষ্টার মধ্যে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং ভারতীয় প্রমাণ আইনের পরিবর্তে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত। তাঁর মতে, ভারতীয় আইনশাস্ত্রের ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি এই নতুন আইনগুলিকে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে রেখে শাস্তির পরিবর্তে ন্যায়বিচারের চেতনাকে স্থান দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, এই নতুন আইনগুলিতে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

তাঁর দাবি, এত বড়ো মাত্রায় সংস্কারের জন্য সাহসী দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়। দেশে একযোগে নির্বাচন পরিচালনার জন্য সংসদে উত্থাপিত বিলটি এমনই আরেকটি প্রচেষ্টা যার মাধ্যমে সুশাসনকে নতুন মাত্রা দেওয়া যেতে পারে। ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা শাসন ব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা বৃদ্ধি করতে পারে। নীতি নির্ধারণে জড়তা দূর করবে, সম্পদের অন্যত্র খরচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমাবে এবং আর্থিক বোঝা  হ্রাস করবে। এগুলো ছাড়াও জনগন আরও নানাভাবে লাভবান হবে।

তিনি বলেন, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের বন্ধন আরও গভীর হয়েছে। এই সময়ে আয়োজিত প্রয়াগরাজ মহাকুম্ভকে সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের একটি কার্যকর প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি সংরক্ষণ করা এবং তাদের মধ্যে নতুন শক্তি সঞ্চার করার জন্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনেক উৎসাহব্যঞ্জক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির মতে, ভারত-ভূমি বিশাল ভাষাগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এই ঐশ্বর্য রক্ষা এবং এই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সরকার অসমীয়া, বাংলা, মারাঠি, পালি এবং প্রাকৃত ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তামিল, সংস্কৃত, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম এবং ওড়িয়া ভাষা ইতিমধ্যেই এই বিভাগে অন্তর্ভুক্ত। সরকার এখন এই ১১টি ধ্রুপদী ভাষায় গবেষণার কাজকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করছে।

তিনি বলেন, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- ইসরো সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মহাকাশ বিজ্ঞান ক্ষেত্রে অনেক বড়ো সাফল্য অর্জন করেছে। চলতি মাসে, ইসরো সফল স্পেস ডকিং পরীক্ষার মাধ্যমে দেশকে আরেকবার গর্বিত করেছে। ভারত এখন এধরনের সক্ষমতা অর্জনকারী হিসেবে গোটা বিশ্বে চতুর্থ দেশ হয়ে উঠেছে। 

তাঁর বক্তব্য, আজকের দিনে আমরা গান্ধীজীর স্বপ্নগুলিকে সাকার করার জন্য নিজেদের দায়বদ্ধতাকে পুনরুচ্চারণ করি। তাঁর সত্য এবং অহিংসার আদর্শ, বিশ্ববাসীর জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। তিনি আমাদের আরও শিখিয়েছেন যে অধিকার এবং কর্তব্য একই মুদ্রার দুটি দিক মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, কর্তব্যই অধিকারের প্রকৃত উৎস। সকলের প্রতি করুণা সম্পর্কে তাঁর শিক্ষাগুলিও আমরা স্মরণ করবো। তিনি বলতেন যে, আমাদের মনে শুধু মানুষের জন্যই নয়, বরং আমাদের আশেপাশের পশু- পাখি, গাছপালা, নদী ও পাহাড়গুলির জন্যও সমবেদনার ভাব থাকা উচিত।

তাঁর আবেদন, আমাদের প্রত‍্যেকের কর্তব্য হল জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলার প্রচেষ্টায় অবশ‍্যই অবদান রাখতে হবে। এই প্রেক্ষিতে দু’টো অনুকরণীয় উদ‍্যোগের উদাহরণ রয়েছে। বিশ্বস্তরে ভারত মিশন লাইফস্টাইল ফর এনভায়রনমেন্ট- নামক একটি গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এর উদ্দেশ্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়নে প্রত্যেক ব‍্যক্তি ও সম্প্রদায়গুলিকে অধিক সক্রিয় হতে অনুপ্রাণিত করা। 

তিনি বলেন, গত বছর, বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে, আমরা আমাদের মাতৃশক্তির পাশাপাশি জীবনদায়িনী প্রকৃতি মায়ের পরিচর্যার ক্ষমতাকে সম্মান জানিয়ে ‘এক পেড় মা কে নাম’ (মায়ের নামে একটি গাছ) বার্তাসহ একটি অনন্য অভিযান শুরু করেছি। এই অভিযানে নির্ধারিত সময়সীমার অনেক আগেই আশি কোটি গাছের চারা লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ববাসী, এমন অভিনব উদ্যোগগুলি থেকে নিজেদের আন্দোলনরূপে গ্রহণ করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *