নয়াদিল্লি, ৯ জানুয়ারি : প্রয়াগরাজের এক শীতের সকালে বাতাসে মিশে যাচ্ছিল তীর্থযাত্রীদের মিষ্টি জপ-গানের সুর| যার সঙ্গে মহাকুম্ভ নগরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালের নানা তৎপরতার মৃদু শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছিল। ব্যস্ততম এই দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রদেশের ৫৫ বছর বয়সী পূণ্যার্থী রমেশ্বর শান্ত হাসি নিয়ে বসেছিলেন| তাঁর বুকের ব্যথা এখন একদম অতীত। এইমাত্র কয়েকদিন আগেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। আইসিইউ বিশেষজ্ঞদের দ্রুত ও দক্ষ পদক্ষেপ এবং অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে তার জীবন রক্ষা পেয়েছে। মহাকুম্ভ ২০২৫-এ স্বাস্থ্য পরিষেবার এই দূরদর্শী ব্যবস্থাপনার জন্য তিনি তাই গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
এ বছর, মহাকুম্ভ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পুনর্জীবনই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর জন্য অদ্বিতীয় চিকিৎসা সেবা দিতেও প্রতিশ্রুত। শক্তিশালী পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে, রাজ্য সরকার এই বিশাল আধ্যাত্মিক সমাবেশটিকে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার এক আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিণত করেছে।
মহাকুম্ভের স্বাস্থ্য পরিষেবার একটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত হলো “নেত্রকুম্ভ” (চোখের মেলা), যা দৃষ্টিহীনতা মোকাবিলায় এক বিশেষ উদ্যোগ। এই আয়োজনের লক্ষ্য হল ৩,০০,০০০ চশমা বিতরণ করা এবং ৫,০০,০০০ ওপিডি বা বহির্বিভাগের সেবা প্রদান করা, যেখানে প্রতিদিন ১০,০০০ জনকে চিকিৎসা-পরামর্শ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই নেত্রকুম্ভে ১১টি হ্যাঙ্গার বা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে পূণ্যার্থীরা সুশৃঙ্খলভাবে চোখের পরীক্ষা করাচ্ছেন। নিবন্ধন করার পর তাঁরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, যেখানে প্রতিটি চেম্বারে চারজন করে বিশেষজ্ঞ এবং দশজন অপটোমেট্রিস্ট রয়েছেন। এই উদ্যোগটি আগেরবারের সাফল্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যা লিমকা বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছিল। এই বছর, এই উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়া। সেবার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধদের জন্য নেত্রকুম্ভে চক্ষুদান শিবিরও রয়েছে। ভারতে দেড় কোটিরও বেশি অন্ধ ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই কর্নিয়ার সমস্যার জন্য অন্ধত্বগ্রস্ত| চক্ষুদান শিবিরের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রে সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পারেড গ্রাউন্ডে কয়েক সপ্তাহ ধরে চালু হওয়া এই সেন্ট্রাল হাসপাতাল মহাকুম্ভের চিকিৎসা পরিষেবার মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১০০টি শয্যার এই হাসপাতালটিতে বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে আই.সি.ইউ. পর্যন্ত নানা ধরনের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা রয়েছে। এই হাসপাতালে ইতোমধ্যেই সফলভাবে সন্তান প্রসব করানো সহ ১০,০০০-এরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করা হয়েছে। শুধুমাত্র বছরের প্রথম দিনেই ৯০০ জন রোগী এখানে চিকিৎসা পেয়েছেন, যা এই ব্যবস্থার আকারের বিশালতা এবং দক্ষতাকে তুলে ধরে। এই উদ্যোগকে সহযোগিতা করে চলেছে আরাইল এলাকার সেক্টর ২৪-এ অবস্থিত সাব-সেন্ট্রাল হাসপাতাল। এই হাসপাতালটি ২৫টি শয্যার এবং এটি আধুনিক সুবিধা সহ সেন্ট্রাল হাসপাতালের মতোই কার্যকরী এবং তা স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই স্বাস্থ্য পরিষেবায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসিজি সুবিধার সূচনা এবং একটি সেন্ট্রাল প্যাথোলজি ল্যাবের ব্যবস্থা| এই ল্যাবে প্রতিদিন ১০০টিরও বেশি পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রয়েছে। পূণ্যার্থীরা ৫০টিরও বেশি বিষয়ের বিনামূল্যে পরীক্ষা করাতে পারেন, যা সামগ্রিক ও ব্যাপক যত্নের পরিষেবা নিশ্চিত করে। সম্প্রতি এই পরিষেবাগুলোর মধ্যে সংযুক্ত হয়েছে ‘এ.আই.-চালিত’ প্রযুক্তি, যা ভাষাগত প্রতিবন্ধকতাকেও দূর করেছে| এর মাধ্যমে ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে নির্বিঘ্নে যোগাযোগ স্থাপন করা সহজ হয়েছে| এই পদ্ধতিতে ২২টি আঞ্চলিক এবং ১৯টি আন্তর্জাতিক ভাষায় কথোপকথন সম্ভব হচ্ছে।
অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রীর ট্রেনযাত্রার সময়েও জরুরি অবস্থা মোকাবিলায়, প্রয়াগরাজ রেল ডিভিশনের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলিতে মেডিকেল অবজারভেশন রুম স্থাপন করা হয়েছে, এই স্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রয়াগরাজ জংশন, নাইনি এবং সুবেদারগঞ্জ। এই অবজারভেশন রুমগুলোতে ২৪X৭ সময়ে ইসিজি মেশিন, ডিফিব্রিলেটর এবং গ্লুকোমিটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সুবিধা রয়েছে। গুরুতর পরিস্থিতিতে রোগীদের নিকটবর্তী হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পাঠানোরও ব্যবস্থা আছে, যা সময়মতো এবং কার্যকরী পরিষেবার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এই অবজারভেশন রুমগুলিতে চিকিৎসক, নার্স এবং ফার্মাসিস্টদের একটি নিবেদিত দল শিফট-ভিত্তিতে কাজ করছেন।
মহাকুম্ভের এই স্বাস্থ্য পরিষেবার মেরুদণ্ড হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ২৪০ জন চিকিৎসকের একটি দল কাজ করছে। এই ডাক্তারদের জন্য ৪০টি ডরমিটরির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে মহিলাদের জন্য আছে আলাদা ব্যবস্থা| তাছাড়া স্বেচ্ছাসেবী ও তীর্থযাত্রীদের জন্যও অতিরিক্ত ডরমিটরির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার বিশেষত্ব হলো অঞ্চলভিত্তিক খাবারের ব্যবস্থা, যা ডাক্তারদের জন্য তাদের সময় এবং দক্ষতাকে উৎসর্গ করতে একটি ঘরোয়া অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে|
এই ব্যাপক প্রচেষ্টার মধ্যে, বিভিন্ন ধরনের আশা জাগানো গল্পও উঠে আসে। যেমন ফতেহপুরের অজয় কুমার এবং পূজা—এই দম্পতি সেন্ট্রাল হাসপাতালে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তাদের এই সন্তানের জন্মকে মহাকুম্ভের পবিত্র আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচনা করে, পবিত্র যমুনা নদী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, তারা সন্তানের নাম রেখেছেন যমুনা প্রসাদ। সন্তান প্রসবের সময় পরিষেবা দান করা চিকিৎসক ডা. জেসমিন নিশ্চিত করেছেন যে, মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছে।
মহাকুম্ভ-২০২৫ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এর চিকিৎসা সুবিধাগুলিও এরকম এক ব্যাপক জনসমাবেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে। আধুনিক আই.সি.ইউ. থেকে উদ্ভাবনী এ.আই. সিস্টেম এবং নেত্র-কুম্ভের মতো সহানুভূতিশীল উদ্যোগ পর্যন্ত, এই আয়োজনটি ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মিশ্রণের এক প্রতিফলন। উত্তরপ্রদেশ সরকারের “স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ” মহাকুম্ভের দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র একটি প্রতিশ্রুতি নয়, বরং এটি একটি বাস্তবতা। রামেশ্বর, অজয় এবং অগণিত মানুষদের জন্য, মহাকুম্ভ শুধুমাত্র একটি আধ্যাত্মিক অভিযাত্রাই নয়; বরঞ্চ এটি এক সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং যত্নের মাধ্যমে নিরাময়ের শক্তির সাক্ষ্যও। পবিত্র নদীগুলির প্রবাহিত হওয়ার মত করে প্রতিটি মানব জীবনে মানবতার সেবা প্রদানের অবিচল প্রতিশ্রুতিও প্রবাহিত হয়ে চলেছে|