গুয়াহাটি, ৯ জানুয়ারি (হি.স.) : চলে গেলেন অসমিয়া ও বাংলা চলচ্চিত্ৰাভিনেত্ৰী তথা কণ্ঠশিল্পী জ্ঞানদা কাকতি। বার্ধক্যজনিত দীর্ঘ রোগভোগের পর বুধবার রাতে ৯২ বছর বয়সে শিলঙের বেসরকারি বেথানি হাসপাতালে অসমিয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্ঞানদা কাকাতি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন৷
অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, মমতাময়ী, দক্ষ অভিনেত্রী জ্ঞানদা কাকতি কেবল অসমিয়া নয়, বাংলা চলচ্চিত্রেও দাপিয়েছেন। ১৯৩২ সালে অবিভক্ত অসমের রাজধানী শিলঙে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর বাবা দেবেন দাস এবং মা বিরজা দাস। তাঁর পিতৃগৃহ গুয়াহাটির পানবাজারে। কিন্তু চাকরিসূত্রে বাবা স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন শিলঙের লাবানে। তাঁর বিয়ে হয়েছিল লোহিত কাকতির সঙ্গে। তাঁদের এক কন্যা আছেন।
১৯৪৯ সালে ‘পারঘাট’ সিনেমার মাধ্যমে অসমিয়া সিনেমা জগতে পা রেখেছিলেন জ্ঞানদা কাকতি। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় অসমিয়া ছবি ‘পিয়লি ফুকন’, ‘সরাপাত’, ‘লখিমী’, ‘রঙা পুলিশ’ (লাল পুলিশ) প্রভৃতি। তিনি মহাজাগতিক পরিমার্জন এবং প্রাকৃতিক কমনীয়তার একটি বিরল সমন্বয়ের অধিকারিণী ছিলেন, যার জন্য তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে এক পৃথক স্থান দখল করেছিলেন। নয়নাভিরাম চেহারা, অভিব্যক্তিপূর্ণ চোখ, সুরেলা কন্ঠস্বর, আবেগে পরিপূর্ণ ভদ্র আচার-ব্যবহার দিয়ে তিনি শ্রোতাদের বিমোহিত করে তাঁদের হৃদয়ে একটি অদম্য ছাপ রেখেছেন।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে জ্ঞানদা কাকতি কুড়ি শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকটি অসমিয়া চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বিপুল খ্যাতি অৰ্জন করেছিলেন। স্থানীয় টেকনিশিয়ানদের সহযোগিতায় কলকাতায় অসমিয়া চলচ্চিত্রের জন্য যখন বেশিরভাগ ইনডোর শ্যুট করা হয়েছিল, তখন তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন।
যে কয়টি জনপ্ৰিয় সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন সেগুলি যথাক্রমে ১৯৫৫ সালে ফণী শর্মা পরিচালিত ‘পিয়ালী ফুকন’। এই চলচ্চিত্রটি প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্র যাকে জাতীয় পুরস্কারে মেরিট সার্টিফিকেট দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল।
১৯৫৬ সালে আনোয়ার হোসেন পরিচালিত ‘সরাপাত’, ১৯৫৭ সালে ভবেন দাস পরিচালিত ‘লখিমী’, ১৯৫৮ সালে নিপ বরুয়া পরিচালিত ‘রঙা পুলিশ’। ষষ্ঠ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ ফিচার ফিল্মের জন্য ‘রঙা পুলিশ’ রাষ্ট্রপতির রৌপ্যপদক লাভ করেছিল। ১৯৫৯ সালে প্রভাত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পূবেরুণ’। ‘পূবেরুণ’ও রাষ্ট্রপতির রৌপ্যপদক জিতেছিল। এছাড়া বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত প্রথম অসমিয়া চলচ্চিত্র ছিল ‘পূবেরুণ’। সে সময় তিনি বার্লিন গিয়েছিলেন। এই ছবিতে মেঘালীর চরিত্র তার কেবল শ্রেষ্ঠই নয়, অবিস্মরণীয় অভিনয়গুলির মধ্যে একটি।
১৯৬১ সালে নিপ বরুয়ার ‘নমস্কার’, ১৯৮৭ সালে প্ৰথম রাগিণী, ১৯৯৩ সালে প্ৰিয়জন, ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘রাগ-বিরাগ’। ‘রাগ-বিরাগ’ চলচ্চিত্রটি ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় প্যানোরামা শাখায় একাধিক জাতীয় পুরস্কার জিতেছে।
এভাবে বহু অসমিয়া চলচ্চিত্রে দাপিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি জ্ঞানদা কাকতি ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’, ‘গড়ের মাঠ’, ‘বড়মা’র মতো উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলিতে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রে বিপুল কৃতিত্ব অৰ্জন করেছিলেন। অহিন্দ্র চৌধুরীর মতো খ্যাতিমান অভিনেতার বিপরীতে অভিনয় তাঁর বহুমুখী প্রতিভার আবেদনকে প্রশস্ত করেছে।
‘বন্দিনী’ শীর্ষক হিন্দি ছবিতে নায়িকার প্ৰস্তাব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই প্ৰস্তাব তিনি প্ৰত্যাখান করেছিলেন।
কেবল অভিনয়ই নয়, জ্ঞানাদা কাকতি আকাশবাণী গুয়াহাটি এবং শিলং কেন্দ্ৰের একজন নিয়মিত কণ্ঠশিল্পীও ছিলেন। দুই কেন্দ্ৰে সংগীত পরিবেশন করার পাশাপাশি তাঁর বহু গান গ্ৰামাফোন রেকৰ্ডে বন্দি করা হয়েছে।
১৯৮৭ সালে ‘প্ৰথম রাগিণী’ ছায়াছবির জন্য শ্ৰেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন অভিনেত্ৰী জ্ঞানদা। এর পর ২০০২ সালে বিষ্ণু রাভা পুরস্কার লাভ করেছিলেন তিনি।