নেশার সাম্রাজ্যে ক্রমশ ডুবছে উত্তর ত্রিপুরা জেলা, করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে অব্যাহত পাচারকার্য

নিজস্ব প্রতিনিধি, ধর্মনগর, ৫ নভেম্বর : উত্তর ত্রিপুরা জেলার ধর্মনগর নেশাখোরদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে । নেশা কারবারীরা উত্তর জেলাকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে নেশা পাচার বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছে । উত্তর জেলাকেই ব্যবহার করে রাজ্যের নেশাকারবারীরা এবং নেশাদ্রব্য ব্যবহারকারীরা রাজ্যে নেশার স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে।

 রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর মানিক সাহার কঠোর নির্দেশ এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তৎপরতায় কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তবে তাদের মূল করিডোর হচ্ছে উত্তর জেলা। এই উত্তর জেলার উপর দিয়েই ফেনসিডিল, এসকফ, করোক্স, ব্রাউন সুগার, হেরোইন, ইয়াবা ট্যাবলেট সহ বিভিন্ন ধরনের নেশাজাতীয় ক্ষতিকারক দ্রব্য রাজ্যে প্রবেশ করছে এবং উপযুক্ত সময় বুঝে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি বের হয়ে যাচ্ছে গাড়ি গাড়ি গাজা।

ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেশা জাতীয় দ্রব্য বের হওয়ার জন্য বা প্রবেশ করার জন্য উত্তর জেলা ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা নেই। উত্তর জেলার চুড়াইবাড়ি অথবা দামছড়া দিয়ে মিজোরাম হয়ে প্রবেশ বা বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ।

 প্রায়ই উত্তর জেলা পুলিশের হাতে নেশাজাতীয় দ্রব্য এবং নেশা কারবারীরা ধরা পড়লেও কারবারিদের দৌরাত্মক কমার কোনো ধরনের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলা যায়। উত্তর জেলায় মোট আটটি পুলিশ স্টেশন রয়েছে। চুড়াইবাড়ি ,কদমতলা, ধর্মনগর ,বাগবাসা, পানিসাগর ,দামছড়া, কাঞ্চনপুর এবং ভাঙ্মুন।

 রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশ এবং উত্তর জেলা পুলিশ সুপার ভানুপদ চক্রবর্তী এর তৎপরতায় জেলার পুলিশ স্টেশনগুলিকে নেশা বিরোধী অভিযানে তৎপর হওয়ার মনোভাব থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিনটি পুলিশ স্টেশন সঠিক ভূমিকা পালন করছে বা পালন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত।

 চুরাইবাড়ি পুলিশ স্টেশনের ওসি হিসেবে সমরেশ দাস যোগদান করার পর নেশা কারবারীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ধর্মনগরে আরক্ষ্য দপ্তরের কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ সচেতন মানুষ নেশা কারবারীদের ধরিয়ে দিচ্ছে যার ফলে প্রশাসনের অনেকটা সুবিধা হয়েছে।
  একইভাবে দামছাড়া পুলিশ স্টেশনে রাজু ভৌমিক দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর নেশা কারবারীদের পক্ষে কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য পুলিশ স্টেশন গুলির কার্যকারিতা নিয়ে বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে। জাতীয় সড়কের উপর বাগ বাসা পুলিশ স্টেশন এবং পানিসাগর পুলিশ স্টেশন থাকলেও চোরাই বাড়িটা নেশা কারবারিদের পক্ষে একটা বিশাল বাধা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ তিনটি পুলিশ স্টেশনের মধ্যে বাগবাসা ও পানিসাগর জাতীয় সড়কে থাকলেও এদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
  এত এত নেশা সামগ্রী রাজ্যে প্রবেশ করছে অথচ চোরাই বাড়িতে ধরা না পড়লে আর ধরা পড়ে না। অনায়াসে রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে নেশা কারবারিদের দৌড়াত্মে নেশা সামগ্রী নেশা ব্যবহারকারীদের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে রাজ্যের স্বপ্ন যুবসমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বিশেষজ্ঞদের মতে রাজ্যে যে পরিমাণ নেশা সামগ্রী প্রবেশ করছে এবং বেরিয়ে যাচ্ছে তার সামান্য একটা অংশ ধরা পড়ছে বাকি সম্পূর্ণটাই কারবারীদের দৌরাত্মে রমারম ব্যবসা চলছে। নেশা কারবারীদের ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতা লক্ষ্য করা গেলেও নেশা দ্রব্য ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে পুলিশে তৎপরতা বেশ ক্ষীন  বলে অভিযোগ উঠে এসেছে। তাছাড়া নেশা কারবারিদের বিরুদ্ধে এনডিপিএস ধারায় মামলা গ্রহণ করা হলেও আইনানুগ ব্যবস্থার দিক দিয়ে পুলিশের রিপোর্টের দুর্বলতার কারণকে সাঙ্গ করে নেশা কারবারীদের ভীতি সম্পূর্ণ চলে গেছে।

 নেশা কারবারিরা তাই প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের দৌরাত্ম্য অব্যাহত রেখে চলেছে। নেশার কবলে পরোক্ষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনজাতিরা। বিশেষ করে দাম ছড়াতে দীর্ঘদিন ধরে নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার এবং কারবার স্বীকৃতির স্বরূপ হয়ে গেছে। প্রতিটি ওষুধের দোকানে সঠিকভাবে তল্লাশি করলে এমন কোন ওষুধের দোকান দামছাড়াতে নেই যার মধ্যে নেশা জাতীয় দ্রব্যের যোগান নেই। শুধুমাত্র নেশাজাতীয় দ্রব্যের উপর ভিত্তি করে দান ছড়াতে একের পর এক ওষুধের দোকান গড়ে উঠছে এবং আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিহীন সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠছে ওষুধের দোকানের মালিকরা। এই এলাকায় যদি পুলিশ প্রশাসন এবং ড্রাগস ডিপার্টমেন্ট যৌথভাবে দোকানগুলিতে অভিযান চালায় তাহলে বেআইনি প্রচুর ড্রাগস বেরিয়ে আসবে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। ড্রাগসের কারণে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে দামছড়ার বিশেষ করে জনজাতিরা। এদিকে কাঞ্চনপুরের থানার বিরুদ্ধে ওসির সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির অভিযোগ উঠে এসেছে। ভাঙ্গ মুন থানা রয়েছে এক রকম না থাকার মত। এই থানার  পুলিশের দায়িত্ব এবং কর্তব্য নিয়ে মানুষ এখনো নিশ্চিত নয়। বীভৎস রূপ ধারণ করেছে উত্তর জেলার শরণার্থী ক্যাম্প গুলি। একদিকে এগুলিতে চলছে ড্রাগসের রমা রম ব্যবসা এবং ড্রাগ ব্যবহারকারীদের দৌরাত্ম্য। পাশাপাশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এইচআইভির মত ভয়ংকর বেধির সংক্রমণ।

এইডস  কন্ট্রোল বোর্ড এবং রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সহায়তায় দিনের পর দিন প্রচুর সচেতনতা শিবির সংগঠিত করে ও এইডসের মরণব্যাধি প্রকোপ থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না এই এলাকাকে। রাজ্যের মধ্যে এইচআইভি প্রকোপ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এই এলাকাকে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে এদেরকে সচেতন করার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সমস্ত চেষ্টাই বৃথা বলে বিবেচিত হওয়ার শামিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজধানী আগরতলার জনজাতিরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভালো খারাপের দিক নিয়ে সচেতন হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনজাতিরা বলা যায় যেই তিমিরে ছিল এখনো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

 পাহাড়ের বিশেষ করে যে এলাকাগুলি প্রত্যন্ত সেখানকার নেংটি পরা জনজাতিদের দৃষ্টিভঙ্গি পূর্বের মতোই রয়ে গেছে। বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি তাদের দৃষ্টিভঙ্গের পাশাপাশি তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার। ঘুম থেকে উঠেই নেশা করা আর পরিবার পরিকল্পনাহীন ভাবে সংসার বৃদ্ধি করা এখনো এদের নিত্যদিনের কাহিনী হয়ে রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে যৌন সঙ্গমের কারণে এইচআইভি সংক্রমনের হার দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। বলা যায় এইচআইভির মুক্তাঞ্চলে পরিণত হচ্ছে এই শরণার্থী শিবির গুলি।

বিভিন্ন দপ্তর গুলিতে এই খবর থাকলেও এবং প্রচেষ্টা থাকলেও কোনমতেই সামাল দিতে পারছে না রাজ্য সরকারের দপ্তর গুলি। এদের মধ্যে অশিক্ষা এবং খ্রিস্টান মিশনারীদের কিছু সংখ্যক কুশিক্ষার কারণে মগজ ধোলাই এমন করে হয়েছে যে তাদেরকে সাধারণ জীবন যথাযাত্রায় ফিরিয়ে আনা কোনভাবেই সম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। যতদিন না তাদের মধ্যে সচেতনতা বোধ আসবে ততদিন পর্যন্ত এইচআইভির মত এবং ড্রাগসের মত মহামারী থেকে এদেরকে রক্ষা করা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। তবুও প্রশাসন ড্রাগসের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়ে ড্রাগস ব্যবহারকারী এবং কারবারিদের সঠিক শাস্তির ব্যবস্থা করলে এখনো ক্ষুদ্র, শান্ত, সবুজ আবৃত রাজ্য কে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *