।। স্নিগ্ধা দাস ।।
করিমগঞ্জ (অসম) ২১ অক্টোবর (হি.স.) : চণ্ডীপাঠ, ঢাক বাজিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কাঁটাতারের ওপারে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে মাতৃবন্দনায় মাতাল বন্দিত্বের শিকার আবদ্ধ ৪৪টি পরিবারের প্রায় ৫০০-এর বেশি ভারতীয় নাগরিক। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁরা। তবে ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে দেবী আরাধনার ইতিহাস রয়েছে তাঁদের।
এবারও আনন্দময়ীর বন্দনায় কোনও খামতি নেই ভারত-বাংলা সীমান্তে বসবাসকারী থাকা গোবিন্দপুরবাসীর। বোধনের দিন থেকেই উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। ভারত ভূখণ্ডের উত্তর করিমগঞ্জের সুতারকান্দি-কুড়িখালা গ্রাম পঞ্চায়েত এবং বাংলাদেশের বিয়ানিবাজারের নয়াগ্রাম সীমান্তে কাঁটাতারের ১৩৬২/১০-এর কাছাকাছি গবিন্দপুর গ্রামের শিবমন্দিরে এ বছর সীমিত সামর্থ্য নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারা আয়োজন করেছেন মহিষাসুরমর্দিনীর রাতুল চরণে অর্ঘ্য নিবেদনের।
আলো নেই, কোনও আধুনিকতাও নেই এখানে, সাত্ত্বিকতা বজায় রেখে নো-ম্যান্স ল্যান্ডের ৪৪টি পরিবারই পুজো কমিটির সদস্য। সকলের দানে এবং বিএসএফ-এর সহযোগিতায় আয়োজন হয়েছে দুর্গা মহোৎসব। এবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা ও দানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মাতৃবন্দনা। এখানে কোনও ধর্মীয় ভাব প্রাচীর গড়ে তুলতে পারেনি। আনন্দে শামিল হয়েছে গ্রামের ইসলাম ধর্মালম্বীরাও। গোটা গ্রাম মিলে আনন্দে কাটাবে পুজোর চারটে দিন। গবিন্দপুরে ৪২টি হিন্দু পরিবার হলেও দুটি পরিবার রয়েছে ইসলাম ধর্মালম্বীর। তবে শারদ বন্দনায় সবাই একাকার।
ধৰ্ম যার যার, উৎসব সবার, এই বার্তাকে সামনে রেখে সবাই একই আনন্দে শামিল হওয়ার ইতিহাস তাঁদের দীর্ঘদিনের। যোগমায়ার আগমনে ঢাকের আওয়াজ আর শঙ্খের ধ্বনিতে চারপাশে বিরাজ করেছে উৎসবের আমেজ।
আলোর ঝলকানি নেই, সীমান্তে বাজিপটকা ফাটাতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এখানে। তবে সব কিছুর মধ্যেও ধরে রাখা হয় পুজোর সাত্ত্বিকতা। প্রতিমা নিয়ে আসা হয়েছে করিমগঞ্জ থেকে। সৌরশক্তি, ব্যাটারি দিয়ে আলোকসজ্জা, মণ্ডপ, সবকিছু তাঁদের নিজের হাতে তৈরি।
গ্রামের বয়ঃজ্যেষ্ঠ জিতেন্দ্র নমঃশূদ্র, বীরেন্দ্র নমঃশূদ্ররা জানান, দেশভাগের কোপে পড়ে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন তাঁরা। তবে পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়েননি। বলেন, বর্ডারে বেশ কিছু নিয়ম থাকে। বিএসএফ-এর বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনেই সন্ধ্যার আগে তাঁদের গ্রামে ফিরতে হয় বারোমাস। ফলস্বরূপ পার্শ্ববর্তী গ্রামে বা শহরের আলোর ঝলকানি সংবলিত পুজোর মণ্ডপ ঘুরে দেখার ভাগ্য হয় না তাঁদের। তবে তাঁদের পুজোয় আনন্দ আছে, উন্মাদনাও আছে।
গোবিন্দপুরের পুজোয় জড়িয়ে রয়েছে দশটি দশকের আবেগ। কিন্তু কাত্যায়নীকে বরণের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলে ভাগ্য নেই অতিথি আপ্যায়নের। দেশের সুরক্ষাজনিত কারণে গ্রামবাসী ছাড়া গোবিন্দপুর গ্রামে অন্যরা পৌঁছতে হলে বিএসএফ-এর বেঁধে দেওয়া বেশ কিছু নিয়ম মানতে হয়। আগাম অনুমতি নিয়ে নথি যাচাই করে নির্দিষ্ট সময়েই অতিথিদের ছাড়পত্র দিয়ে থাকে বিএসএফ।
এবারের পুজো-উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম বিপুল নমঃশূদ্র, সজল নমঃশূদ্র, অনিল নমঃশূদ্র, দীবেন্দ্র নমঃশূদ্র, দেবু নমঃশূদ্ররা জানান, সীমান্তের খবর সংবাদ মাধ্যম অবধি পৌঁছয় না। পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই চলে আসছে এখানে পরমেশ্বরীর আরাধনা এবং মায়ের আশীর্বাদে স্বল্প আয়োজনে এর ধারাবাহিকতা তাঁরা বজায় রেখেছেন আজ অবধি। পুজোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হবে মঙ্গল আরতি। গোটা গ্রামকে সাজানো হয় নানারূপে। অষ্টমী ও নবমীর রাতে আরতি ও ঢাক বাজানোর প্রতিযোগিতা হয়। বিপুল-সজলরা জানান, সীমান্তে বিএসএফ-এর কিছুটা কড়াকড়ি থাকলেও ভবানী বন্দনার আয়োজনে সবচেয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এই সীমান্তরক্ষীরাই। আর্থিক অনুদান, পানীয় জলের ব্যবস্থা, মণ্ডপ নির্মাণ, আলোকসজ্জায় বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করে সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন জওয়ানরা।