।।সুনীল দেবনাথ।।
শৈশব, কৈশোর, যৌবন কাটিয়ে রাজ্যের প্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র জাগরণ আজ ৭০ তম বর্ষে পদার্পণ করল। এই ঐতিহ্যময় পদার্পণ শুধু জাগরণ পরিবার কিংবা রাজ্যবাসীর গর্ব নয়, গোটা দেশবাসী ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অন্যতম গর্বের বিষয়। গুটি গুটি পায়ে নানা ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে ৭০তম বর্ষে জাগরণ-এর পদার্পণ নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জিতেন্দ্র চন্দ্র পাল ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীও বটে। জীবন যৌবন উজাড় করে দিয়ে তিনি সংবাদপত্রকে আগলে রেখেছিলেন। বার্ধক্যে এসে যখন সংবাদপত্র প্রকাশনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন এই সংবাদপত্র প্রকাশের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে দিয়েছিলেন তৎকালীন লড়াকু যুবক বর্তমান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় পরিতোষ বিশ্বাস মহোদয়ের হাতে। জাগরণ নিয়মিত প্রকাশ করা যে মোটেই সহজ ছিল না সংবাদপত্র জগতসহ সকলেই অবগত রয়েছেন। তদুপরি আধ পেটা খেয়ে জাগরণ সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ করা থেকে পিছুপা হননি বর্তমান সম্পাদক মহোদয়। যদিও বর্তমানে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী। তবুও নিয়মিত সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহের কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়নি। জাগরণের সত্তর তম বছরে পদার্পণ দিবসে সংবাদপত্রটির উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি সকলের প্রত্যাশা।
ঐতিহ্য বুকে আগলে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই মূল লক্ষ্য৷ ১৯৫৪ সালের ২রা অক্টোবর রাজ্যের বুকে আত্মপ্রকাশ ঘটে দৈনিক সংবাদপত্র জাগরণ-এর৷ সূচনাতেই দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় জাগরণ ৷ ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়ে যায় জাগরণ-এর নাম৷ সেদিনের একমাত্র দৈনিক সংবাদপত্রটি আজও সগৌরবে প্রকাশিত হচ্ছে৷ কালের বিবর্তনের সাথে জাগরণেরও পরিবর্তন হয়েছে৷ এনেছে আধুনিকতার ছোঁয়া৷ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে হাত মিলিয়েছে প্রযুক্তির সাথেও৷ এসবের মধ্যে সত্যনিষ্ট খবর পরিবেশনে আজও অবিচল৷ নানা ঘাত–প্রতিঘাত সত্বেও এগিয়ে চলেছে৷ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে মানুষের চাহিদা, বেড়েছে গ্রহণযোগ্যতা৷ জাগরণ লক্ষ্যে অবিচল৷
সংবাদপত্রের ভূমিকা একটি স্বাধীনতাকামী জাতিকে কতটা উদ্ধুদ্ধ করেছিল, তা ইতিহাসে লেখা রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক গবেষণায় নতুন তথ্য পাওয়া যাবে, যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সময়ের সাক্ষী হয়ে দেশ কিভাবে দেশ হয় তা উপলব্ধি করার সুযোগ থাকবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ১০ মাসে ১৫ লক্ষাধিক মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে মুক্তিযুদ্ধের নানা খবর নিয়ে জাগরণ মানুষের বিশ্বাসকে মজবুত করেছিল। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ছে মুক্তিযোদ্ধারা। এই খবর গুলো কেউ কেউ পত্রিকা পড়েই সবিস্তারে বর্ণনা করতেন। প্রচারমাধ্যম যুদ্ধের একটি বিশেষ হাতিয়ার। সেই সময় বর্তমানের মত তথ্যপ্রযুক্তি ইন্টারনেট কেন্দ্রিক নয়, টেলিগ্রাফ এবং বেতার নির্ভর হয়েও একটি দেশের স্বাধীনতার সপক্ষে হাতিয়ার ছিল। সংবাদপত্রের মাধ্যমে একদিকে যেমন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, অন্যদিকে সাধারণের মনোবল বাড়ানোর হাতিয়ার করা যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তি সংগ্রামের ছবি ক্যামেরায় তুলে ধরতে গেছেন আলোকচিত্রশিল্পীরা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরার অবস্থান সামরিক দিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে হিসেবেও গুরুত্ব ততটাই ছিল। সেই সময়কার সংবাদ পত্রের প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন কাগজের সাংবাদিক এবং আলোকচিত্রীদের কর্মস্থল হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরার সীমান্ত অঞ্চল।জাগরণ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের খবর সহ সংবাদ নিবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়মিত প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন রাজ্য থেকে সাংবাদিক এবং পূর্ব বাংলা থেকে আসা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষাব্রতী, কবি লেখক শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিয়মিত লেখা জাগরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খবরও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হতো। যুদ্ধের খবর কেবল নয়, নানা দুর্দশা, আক্রমণ, সীমান্তে গোলা বর্ষণ ত্রিপুরাতে জনঢল সমস্ত খবরই জনসাধারণের মধ্যে আশঙ্কার পাশাপাশি দেশের মুক্তির বার্তা বহন করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ভারত সরকারের ভূমিকা ও মিডিয়ার প্রচার বিশ্ববাসীকে সজাগ করে তুলেছিল।
১৯৭১ এর ২৫ শে মার্চ স্বাধীনতাকামী মানুষের উপর যেভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং ঢাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের সমস্ত প্রচারমাধ্যমের যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, তাতে সর্বভারতীয় দৈনিক পত্রিকা সংবাদ সংস্থা এবং খবরের বিভিন্ন সংস্থা গুলি ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদপত্র জাগরণের ওপর অনেকাংশে নির্ভর শীল হয়ে পড়ে।
১৯৭১ সালে আগরতলায় জাগরণ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তা বর্তমান প্রজন্মের জানা প্রয়োজন। আরো বেশি জানা প্রয়োজন এ প্রজন্মের প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের। কতটা সাহস এবং জনগনের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে ছোট্ট রাজ্যের ছোট পত্রিকাটি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন লক্ষাধিক মানুষের দুর্দশার কথা, সংগ্রামের কথা, পাকবাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা। একাত্তরে রাজ্যের সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষের ছিল অনন্য ভূমিকা। তাদের সাহসী ভূমিকা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছিল সাহস, শরণার্থীদের দিয়েছিল আশ্রয় ও সেবা, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছিল বাংলাদেশকে সর্বাত্নক সহায়তা দিতে।
অন্যদিকে, বহিবিশ্বে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের সমর্থনে এক ব্যাপক আন্তর্জাতিক জনমতের। কাঠের টাইপে শিরোনাম, সীসার হরফে ছাপা অস্পষ্ট সাধারণ দেশী কালির ছাপসমেত ট্যাবলয়েড সাইজের ৪ পৃষ্ঠা, কখনও ২ পৃষ্ঠার পত্রিকাগুলাে যেন একেকটি বারুদের স্তুপ তৈরী করেছিল সেই সময়ে। ভ্রাতৃপ্রতিম জন-মানুষের সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও আতিথেয়তা ছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম সম্বল। সব মিলিয়ে ত্রিপুরা জড়িয়ে পড়েছিল এক অন্যরকম জনযুদ্ধে। ত্রিপুরার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র জাগরণ সেক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সংবাদপত্রের সমৃদ্ধ ইতিহাস আজ হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেই ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখা খুবই প্রয়োজন৷ নবীন প্রজন্মের সেই ইতিহাস জানা খুবই জরুরি৷ অতীত দিনের স্মৃতিতে ত্রিপুরায় বহু প্রতিথযশা সাংবাদিক নিজেদের কাজের মাধ্যমে স্বর্ণালী ছাপ রেখে গেছেন৷ না খেয়ে খালি পেটে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন৷ তাঁরা নমস্য ব্যক্তি৷ তাঁদের লেখার মুন্সিয়ানা আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷ ত্রিপুরার সংবাদপত্রের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ নতুন প্রজন্মের সেই ইতিহাস সম্পূর্ণ অজানা৷
তাঁদের সে সম্পর্কে জানাতে হবে৷ তাতে, সরকারের সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে৷ সাংবাদিকতায় এবং সংবাদ মাধ্যম পরিচালনায় ত্যাগ ও আদর্শে অবিচল থাকতে হবে৷ কঠিন তপস্যা এবং ত্যাগের বিনিময়ে সাংবাদিকতা সম্ভব ৷ আদর্শ ছাড়া সাংবাদিকতা কিংবা সংবাদ মাধ্যম পরিচালনা সম্ভব হবে না৷ অতীত দিনের স্মৃতি অনুসরণ করলে দেখা যায়, সংবাদমাধ্যম আক্রান্তের ঘটনা নতুন নয়৷ সরকারের শোষণের শিকার অতীতেও হয়েছে সংবাদমাধ্যম। মনে রাখতে হবে ত্যাগ ও স্বার্থ একসাথে সম্ভব নয়৷