কিডনি রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে

যদি পরীক্ষা না করেন তাহলে সে জানতেই পারবেন না তার কিডনি সমস্যা শুরু হয়েছে৷ অনেকের কোন উপসর্গ থাকে না৷ ফলে তিনি জানতেই পারছেন না অসুখ আছে : ডা: দিলীপ কুমার পাহাড়ি

।।সন্দীপ বিশ্বাস।।

কিডনি রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডা: দিলীপ কুমার পাহাড়ির নাম আজ সর্বব্যাপী৷ তিনি আমার পিতা জাগরণ সম্পাদক পরিতোষ বিশ্বাসের চিকিৎসক৷ এই কিডনি রোগ অনেক অজ্ঞতার কারণেও ঘটছে৷ তাই, ভাবলাম এই রোগ সম্পর্কে ডা: পাহাড়ির অভিজ্ঞতা কিছুটাও যদি তুলে ধরা যায় তাহলে রোগীরা অনেক উপকৃত হবেন৷

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে মানুষের জীবন-জীবিকায় এসেছে আমূল পরিবর্তন৷ এরই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নানা রোগ৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিন্তু, নানা রোগের থাবায় জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷ মানুষ এখন প্রতিনিয়ত হার্টের সমস্যা, লিভার, কিডনি, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের জাতাকলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়৷ সাম্প্রতিককালে কিডনি রোগের সমস্যা রীতিমত মহামারির রূপ নেওয়া শুরু করেছে৷ ফলে, ওই রোগের লক্ষণ এবং প্রতিকার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের সনামধন্য কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা: দিলীপ কুমার পাহাড়ির সম্প্রতি নেওয়া একান্ত সাক্ষাতকার এখানে তুলে ধরা হল৷

প্রশ্ন : রোগীর সেবায় দীর্ঘ কর্মময় জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কি?
উত্তর : প্রথমে বলি, ১৯৮৫ সালে আমি কিডনি চিকিৎসায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম৷ মেডিসিনে এমডি পাস করার পরে ভাবছিলাম কার্ডিওলজি পড়ব নাকি নেফ্রোলজি নিয়ে পড়াশুনা করব৷ তখন দেখলাম কিডনি অসুখের পড়াশোনার সুযোগ ভারতে খুব কম ছিল৷ চণ্ডিগড়ে একমাত্র কলেজ ছিল যেখানে কিডনির অসুখ সংক্রান্ত পড়ানো হত৷ অন্য জায়গায় তখনো এতটা উন্নতি করেনি৷ ভেলোর কিংবা এইমসে তখন কিডনির পড়াশোনা ছিল না৷ দ্বিতীয় কারণ, তখন আমরা দেখলাম কার্ডিওলজি অনেক উন্নতি হচ্ছে৷ কিন্তু কিডনির রোগ আছে, শুধু চিকিৎসক নেই৷ কিডনির চিকিৎসায় ট্রেনিং হয়না সব জায়গায়৷ ফলে ডাক্তারের অভাব খুবই বেশি৷ কিন্তু রোগ আছে এবং সেই রোগ প্রতিদিন বাড়ছে৷ সেই অনুভূতি থেকেই কিডনি রোগের চিকিৎসার প্রতি আগ্রহ পেলাম এবং চণ্ডিগড়ে গিয়ে ভর্তি হলাম৷
চন্ডিগড় থেকে পাস করার পর দীর্ঘদিন সরকারি চাকুরীতে ছিলাম৷ তখন পিজি হাসপাতালে চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলাম৷ একটানা প্রায় ১৪ বছর সেখানে কিডনি রোগের চিকিৎসা করেছি৷ পিজি হাসপাতালে তখন কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হতো না৷ আমরাই প্রথম কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু করেছিলাম৷ সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে৷ এরপর ডায়ালাইসিস শুরু হল৷ পর্যায়ক্রমে কিডনি বায়োপসি থেকে শুরু করে ওই রোগের যাবতীয় সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা এসএসকেএম হাসপাতালে আমার হাত দিয়েই শুরু হয়েছে৷ ২০০২ সাল থেকেই সরকারিভাবে পশ্চিমবঙ্গে কিডনি রোগের সমস্ত চিকিৎসা শুরু হয়েছে৷ তারপর কিছুদিন আমেরিকা ছিলাম৷ সেখান থেকে ফিরে চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি৷ তারপর কিছু দিন আরএন ঠাকুর হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম৷ বর্তমানে মেডিকা হাসপাতালে নেফ্রোলজি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছি৷ বেসরকারি হাসপাতালের সাথে সরকারি হাসপাতালের কিছু তফাত রয়েছে৷ বেসরকারি হাসপাতালে যখনই যা দরকার তখনই করতে পারব৷ কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সেই স্বাধীনতা ছিল না, সাথে পরিকাঠামোরও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল বলেই তা সম্ভব হয়ে উঠে না৷ এখন অবশ্য সরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসার পরিকাঠামো বৃদ্ধি হয়েছে৷ ডায়ালাইসিস আগে তেমন ছিল না৷ ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ডায়ালাইসিস সেন্টারের সংখ্যা খুবই কম ছিল৷ কলকাতার বাইরে ছিলই না৷ তারপর আস্তে আস্তে কলকাতার বাইরে সেন্টার গড়ে উঠতে শুরু হল৷ এরপর কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের তহবিল মিলিয়ে প্রত্যেক জেলায় ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে উঠেছে৷ চিকিৎসার পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছে এবং তাতে রোগী উপকৃত হচ্ছেন৷

প্রশ্ন: কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে৷ ফলে এই রোগের চিকিৎসায় এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন এবং নিয়ে যাচ্ছেন৷ এই রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং বৃদ্ধি ঠেকাতে কি কি করণীয়?
উত্তর : মানুষের পরমায়ু বেড়েছে৷ ফলে কিছু অসুখ হবেই৷ আগে একটা রোগীর সুগার হল৷ সুগার ৩০-৪০ বছরে দেখা দিলে ৫০ বছর বয়সে তিনি মারা যেতেন৷ এখন চিকিৎসা শুরু হওয়ায় তার আয়ু বেড়েছে৷ কিন্তু সাথে অন্য রোগ যেমন হার্টের রোগ, কিডনি সমস্যা, স্ট্রোক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন৷ মানুষের গড় পরমায়ু বেড়েছে, সাথে বিভিন্ন রোগের জটিলতাও দিন দিন বাড়ছে৷ ডায়াবেটিস কিছু ঔষুধ বেরিয়েছে৷ ডায়াবেটিসের এমন ঔষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে ভবিষ্যতে কলস্টেরল, হার্টের সমস্যা, কিডনির সমস্যা ইত্যাদি কম হয়৷ নতুন ঔষুধ বেরিয়েছে তাতে কিডনির সমস্যা কমতে পারে৷ অন্যদিকে, প্রেসার আছে সুগার নেই৷ তাতে, হার্টের সমস্যা বা স্ট্রোক এড়ানো যাবে৷ কিন্তু কিডনির সমস্যা আটকানো যাবে এমন ঔষুধ এখনো বের হয়নি৷ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে, কিন্তু পুরোপুরি আটকানো যাচ্ছে না৷ তৃতীয় সমস্যা হল, যে কোন অসুখ থেকেই হোক সেটা নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার শুরু হয়ে কিডনি খারাপ হল সামান্য৷ তখন যদি চিকিৎসা করে আটকানো যায়, ক্রিয়েটিনিন ২ বা ২.৫ তে রাখা যায় তবে কিডনি ড্যামেজ স্লো করা যাবে৷ কিন্তু, পুরোপুরি আটকানো যাবে তা নিশ্চিত ভাবে বলা মুশকিল৷ তবে, ডায়াবেটিস এবং ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেই কিডনি রোগ থেকে অনেকাংশে মুক্তি পাওয়া যাবে৷

প্রশ্ন : সাধারণ মানুষ কিভাবে মোকাবিলা করবেন?
উত্তর : সব ক্ষেত্রে মোকাবিলা সম্ভব নয়৷ আগে এক ধরণের নেফ্রাইটিস হতো সে ধরণের সমস্যা এখন অনেক কমে গেছে৷ সুস্থ লোক তার হঠাৎ নেফ্রাইটিস শুরু হল সেটা আটকানো যাবে তেমন চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয় নি৷ বেশিরভাগ যা হচ্ছে, নেফ্রাইটিস হয়ে গেছে পড়ে পরীক্ষা করলে হয়তো দেখা যাবে তার ইউরিণে প্রোটিন রয়েছে, বা ব্লাড বের হচ্ছে৷ কিন্তু যদি পরীক্ষা না করেন তাহলে সে জানতেই পারবেন না তার কিডনি সমস্যা শুরু হয়েছে৷ অনেকের কোন উপসর্গ থাকে না৷ ফলে তিনি জানতেই পারছেন না অসুখ আছে৷ স্কুল স্তরে ইউরিণ পরীক্ষা করা উচিত৷ বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া খুবই জরুরি৷ কিডনি সমস্যা সনাক্ত করার জন্য ইউরিণে প্রোটিন, ব্লাড, আরবিসি আছে কিনা, আল্ট্রা সাউন্ড করে দেখা সিস্ট বা স্টোন আছে কিনা, অথবা ইউরিয়া ক্রিয়াটিনিন নরমাল আছে কিনা তা দেখে নেওয়া উচিত৷

প্রশ্ন : কিডনির চিকিৎসায় প্রতিকূলতা যা এখনো কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি?
উত্তর : কিছু পরীক্ষা কলকাতায় হয় না৷ বাইরে থেকে করতে হচ্ছে৷ তাতে রেজাল্ট পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে৷ যেমন কিডনি বায়োপসি, ঔষুধের লেভেল পরীক্ষা হয় না৷ পরীক্ষার ল্যাবোরেটরী দিল্লি, মুম্বাই হয়েছে কলকাতায় এখনো সম্ভব হয়নি৷

প্রশ্ন : চিকিৎসক ঘাটতি মেটানো কতটা সম্ভব হয়েছে ?
উত্তর : কিডনি রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিন্তু, ছোট ছোট শহরে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে৷ হয়ত, ভবিষ্যতে অনেক বেশি চিকিৎসক হলে তখন বড় শহরের সাথে ছোট শহরেও ঘাটতি মিটবে৷ তবে, সেই লক্ষ্যে সরকারের এমন কোন পলিসি নেই৷ ফলে, জেলা স্তরে ডায়ালাইসিস সেন্টার কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই চলছে৷

প্রশ্ণ : চিকিৎসার বাইরে জনসেবা?
উত্তর : কিছু কিছু জায়গায় করেছি৷ চারটে গ্রামে সমস্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের রক্ত, ইউরিণ পরীক্ষা করেছি৷ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি৷ অসুখ হটাৎ হয়নি৷ আগে পরীক্ষা করে দেখলে রোগ আগে ধরা পড়ত৷ ডাক্তারের কাছে আসছে না৷ সময় সময় পরীক্ষা করতে হবে৷ বাঙালিরা মিষ্টি বেশি খায়৷ চিলিতে কোন রেষ্টুরেন্টে খাবারে নুন দেওয়া যাবে না৷ দেশে আইন করে রেখেছে৷ এধরনের সচেতনতার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি৷

প্রশ্ন : আপনার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছেন৷ এ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন৷
উত্তর : কিডনি রোগের চিকিৎসাই ছিল প্রধান লক্ষ্য৷ সেই লক্ষ্য থেকেই আজীবন কাজ করে গেছি৷ একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপনের জন্য বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ নেফ্রোলজি দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছি৷ এছাড়া, আমেরিকান সোসাইটি অফ নেফ্রোলজি, রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস (গ্লাসগো), ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ নেফ্রোলজি এবং ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অফ নেফ্রোলজি দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছি৷