মৌলবাদীদের হটবেডে পরিণত অসম, ইমাম ও মাদ্রাসা-শিক্ষকদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর গোয়েন্দা-পুলিশের : মুখ্যমন্ত্ৰীর

রাজ্যের যে কোনও প্রান্তে নবাগত ইমাম, সন্দেহজনক কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান হিমন্তবিশ্ব শর্মার

গুয়াহাটি, ৪ আগস্ট (হি.স.) : মৌলবাদীদের হটবেডে পরিণত হয়েছে অসম। মসজিদের ইমাম এবং মাদ্রাসা-শিক্ষকদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে গোয়েন্দা-পুলিশ। বলেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। রাজ্যে মৌলবাদি জিহাদির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে রাজনীতি না করারও আহ্বান জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি মৌলবাদী শনাক্ত করতে মুসলমান সমাজের প্রতি আর্জি জানান তিনি।

রাজ্যের পুলিশ-প্রধান ভাস্করজ্যোতি মহন্তকে পাশে বসিয়ে আজ বৃহস্পতিবার জনতা ভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে রাজ্যের বঙাইগাঁও, বরপেটা এবং মরিগাঁও জেলায় মৌলবাদী ও জিহাদির বিরুদ্ধে অসম পুলিশ ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে৷ অথচ এভাবে জিহাদি-বিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহল থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তাই আজ আমাকে নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে গোটা ঘটনাবলির তথ্য দিতে হচ্ছে।’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গত দু মাসে যে ১৩ জন জিহাদিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র কতিপয় রাষ্ট্রবাদী মুসলমান সূত্রের ভিত্তিতে। আমরা কখনও গোটা মুসলমান সমাজকে এর জন্য দায়ী করিনি বা করবও না।’

অতএব জিহাদি মৌলবাদী শনাক্ত করতে মুসলমানদের সহযোগিতা চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা। রাজ্যের যে কোনও প্রান্তে নবাগত, সন্দেহজনক কাউকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দিতে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বলেন, এ ক্ষেত্রে সূত্রের পরিচয় নিশ্চিতভাবে গোপন রাখা হবে।

মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা আরও বলেন, প্রকৃত ইমামদের তিনি শ্রদ্ধা করেন। সব মুসলমান সমান নয়৷ মসজিদে স্থানীয় ইমাম না থাকলে অন্য ইমামদের কোনও ধরনের সেবা বা শুশ্ৰুষা না করতে বলেছেন তিনি৷ তাছাড়া বহিরাগত নবাগত ইমাম আসলে স্থানীয় পুলিশকে খবর দিতেও মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানান ড. শৰ্মা৷ তাছাড়া কোনও ইমামের গতিবিধি সন্দেহজনক বলে মনে করলেও সঙ্গে সঙ্গে থানাকে অবগত করতে একইভাবে মুসলমান সমাজের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন রাজ্য প্রশাসন জিহাদি গোষ্ঠীকে উৎখাত করতে সক্ষম হচ্ছে৷’

প্রায় পৌনে দু-ঘণ্টার সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা বলেন, ১৯৯৯ সালে অসমে জিহাদির ঘাঁটি উৎখাত করা হয়েছিল৷ ওই সালে উৎখাত করা হয়ছিল হরকত-উল-মুজাহিদিনের ঘাঁটি। ২০০৩-০৪ সালে হরকত-উল-ইসলামি, ২০১১ সালে জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ, ২০১৮-২২ আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও আল-কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)-এর ঘাঁটি উৎখাত করা হয়েছিল অসমে৷ এক মাসে পাঁচটি গোষ্ঠী আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম উৎখাত করেছে অসম পুলিশ৷

বরপেটা জেলায় গত ৪ মাৰ্চ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম-এর একটি গ্রুপকে উৎখাত করা হয়েছিল৷ এই দিন মহম্মদ সুমন নামের এক জিহাদিকে গ্ৰেফতার করা হয়েছিল ছয়জনের এক দলের সঙ্গে৷ এরা সকলেই বাংলাদেশি নাগরিক। এই সুমন নিজেকে অনাথ পরিচয় দিয়ে স্থানীয় এক যুবতীকে বিয়ে করে অসমে ঘাঁটি গেঁড়েছিল। ওই মামলা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, জানান মুখ্যমন্ত্রী৷

তিনি জানান, গত ১৪ এপ্ৰিল ছয় দলের দ্বিতীয় গ্রুপকে উৎখাত করা হয়েছে৷ বঙাইগাঁওয়ে গত ১৫ এপ্ৰিল চারজনকে গ্রেফতার করে তৃতীয় গোষ্ঠীকে উৎখাত করা হয়৷ ২৭ জুলাই বরপেটা জেলায় আরও একটি গোষ্ঠীকে উৎখাত করা হয়েছে ৯ জনকে গ্ৰেফতা করে৷

মরিগাঁওয়ের মৌলবাদী গোষ্ঠী অত্যন্ত ভয়ংকর বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, আল-কায়দা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট-এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম৷ মৌলবাদী বা জিহাদিদের বেশ কিছু তথ্য রাজ্য প্রশাসনের হাতে এসেছে এবং এ সব এসেছে মুসলমানদের কাছ থেকেই৷ হিমন্তবিশ্ব বলেন, মৌরাবাড়ির সাহারিয়া গ্রামের জমিউত-উল-হুদা মাদ্রাসা পরিচালিত হত জিহাদি আল কায়দার ভ্রাতৃ সংগঠন আনসার-উল্লা বাংলা টিম (এবিটি)-এর অৰ্থানুকূল্যে। এর প্রধানশিক্ষক তথা জিহাদি-লিংকম্যান অভিযোগে গত ২৮ জুলাই মুফতি মুস্তাফা আহমেদ সহ আট শিক্ষককে গ্ৰেফতার করেছে পুলিশ। জমিউত-উল-হুদা মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ-যোগ, টাকার লেনদেন এবং জিহাদ-সম্পর্কিত বহু পুস্তিকা, নথিপত্রও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছিল।
জিহাদি কাৰ্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে মুফতি মুস্তাফার স্ত্রী ও এক ভাইকে আটক করা হয়েছে। মুফতি মুস্তাফা আহমেদ প্ৰথমে লখনউ, এর পর মধ্যপ্রদেশ এবং শেষে মহারাষ্ট্র থেকে শিক্ষা ও সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ নিয়ে অসমের মরিগাঁও জেলার মৈরাবাড়িতে আসে। এখানে এসে সে স্বউদ্যোগে জমিউত-উল-হুদা নামে নিজস্ব একটি মাদ্ৰাসা তৈরি করে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের পাঠ দিত। ওই মাদ্রাসা থেকে মৌলবাদী সম্পর্কিত বহু বই, পুস্তিকা ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শান্তিপ্ৰিয় মুসলমান নাগরিকদের এই সব মৌলবাদী শক্তিকে উৎখাত করতে সরকারকে সহায়-সহযোগিতা করার আহ্বান জানান মুখ্যমন্ত্ৰী। তিনি বলেন, ‘এখন থেকে আমরা মসজিদের ইমাম এবং মাদ্ৰাসার শিক্ষকদের ওপরও তীক্ষ্ণ নজর রখব৷ অসমে কৌমি মাদ্ৰাসা ৮০০, হাফিজি মাদ্ৰাসা ৫০০ এবং বানাত মাদ্ৰাসা আছে ২০০টি।
মাদ্ৰাসাগুলিতে কী পড়ানো হয় সে সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখতে সংশ্লিষ্ট স্থানীয়দের প্রতি আহ্বান জানান মুখ্যমন্ত্ৰী। মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেন, ‘কোভিড কালে আনসার-উল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) জিহাদি কাৰ্যকলাপ মজবুত করেছে৷ যে সময় আমরা কোভিডের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত ছিলাম, সে সময় তারা সুযোগের অপব্যবহার করেছে।
মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, এই সব জিহাদি সাধারণত সন্ত্রাসরাজ কায়েম নয়, বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে জোটবদ্ধ করে তাদের মাথায় মৌলবাদীর ভাবধারা ঢুকিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্ৰোহ করার অপচেষ্টা করে৷ অন্য জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের কেউ ১৫ আগস্টে বোমা বিস্ফোরণ সংগঠিত করে সরকারের তথা জনসাধারণের দৃষ্টি আকৰ্ষণ করতে চায়৷’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *