জবিগনিয়েও কাজিমিরেজ ব্রজিজিনস্কি এবং আফগানিস্তান

ডা : কনক চৌধুরী

নিচের ছবি ও উপরের এই পোলিশ-আমেরিকান। নামটা মনে রাখুন। এইবার আমি অনেকটা পিছিয়ে যাচ্ছি। ১৮২০ থেকে ১৯১৯। প্রায় একশো বছরের পরাধীন আফগানিস্তান। তৃতীয় আফগান যুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ ছেড়ে যায় আফগানিস্তান। রাশিয়ান জার এবং বৃটিশ শক্তির একটাই ছিলো নিশানা, এই অতি দুর্গম রুক্ষ পাহাড়ের দখল নিয়ে ; অন্যদের উপর দখলদারী। সাল ১৯৩০।

আফগানিস্তানের তরুণ রাজা আমানুল্লাহ সম্ভব হলেই ইউরোপ-মধ্য এশিয়া-আমেরিকার দেশগুলোতে ঘুরে বেড়াতেন। তাদের উন্নয়ন ও জীবনযাত্রা রাজাকে মোহিত করে রাখতো। তৃতীয় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশের রাজা হিসেবে তিনি আফগানিস্তানের উন্নয়ন কল্পে সাহায্য চান উন্নত দেশগুলোর কাছে। হায় বিধি!

জবিগনিয়েও কাজিমিরেজ ব্রজিজিনস্কি

১৯৩৪ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে ইউনাইটেড স্টেটস কাবুলে তাদের দূতাবাস খুলে দিলো। ১৯৪৫ থেকে ৫৬ পর্যন্ত আমেরিকা তিন দফায় রাস্তা,সেচ,তেল উত্তোলন প্রকল্পে ব্যয় করলো প্রায় (২১+৫১.৭৬+২১) মিলিয়ন মার্কিন ডলার ! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আফগানিস্তানের জনসংখ্যা ৪ কোটি মাত্র। ৬৫২২৩০ বর্গ কিলোমিটার এর আয়তন। সেই হিসেবে,তখনকার অতগুলো টাকা গেলো কোথায়? রাশিয়াও বসে ছিলো না। তারাও ক্রসরোডের এই দেশে ১৯৭০-৭৩ এর মধ্যে খরচ করেছে এক বিলিয়ন ডলারের বেশী। এর ৬০% ছিলো আন্তর্জাতিক সাহায্য।

কিন্তু, আফগানিস্তানের লোকেরা তখনও উপলব্ধিই করেনি, বন্দুক আর চাকু নিয়ে সাজগোজ করে তারা যতই দ্রুত ডলার হজম করুক,আমেরিকা ও রাশিয়া ততদিনে বুঝে গেছে, বানিজ্য বা শিল্প এখানে নিষ্ফলা ! ১৯৭৮ অব্দি আফগান-রাশিয়া ঘষাঘষি নিয়ে আমেরিকাও তত মাথা ঘামায়নি। কারন এই মধ্য এশিয়ার মুসলিম সেন্টিমেন্ট তখন ইরানের শাহ এর দ্বারা পরিচালিত হতো। আর শাহ ছিলো আমেরিকার বন্ধু। ১৯৭৮ এ একসাথে দুটো ঘটনা ঘটে। ইরানে শাহ এর পতন,কাবুলের রাজা দাউদের অপসারণ ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান(PDPA) এর ক্ষমতা দখল। সাথে সাথে CIA নড়ে চড়ে বসলো।

এদিকে নব্য কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা আফগানিস্তানের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত লোকদের উপর একেবারেই অপ্রয়োজনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক জমি অধিগ্রহণ নীতি, লেলিন ও স্ট্যালিনের মেনিফেস্টো’র সালাদ বানিয়ে পরিবেশন করতে জোর প্রয়োগ করতে থাকলো। ২৮টি প্রদেশ জুড়ে শুরু হলো খুন, খারাবি, অরাজকতা। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ এক হতে থাকলো এক ছাতির নিচে। কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে।

ইসলাম। CIA খুশ হুয়া। মেঘ না চাইতে জল। আমার গল্পের নায়ক তখন আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি আডভাইসার। যে আফগানিস্তানকে নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছিলো না বছর খানেক আগে, আগের উল্লেখিত কারন দুটোর কারনে ব্রেজেন্সকি, তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট কার্টারকে লিখলেন, “to treat this Soviet policy towards Afghanistan as the gravest threat to world peace since World War II” ! এর পরেই শুরু হলো আমেরিকার ভালোবাসার কাহিনি, ইসলামের সাথে !

আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির সাহায্যে ১৯৭৯ এর বড়োদিনের শুরুতে রাশিয়া আফগানিস্তানে দখলদারি সৈন্যদল পাঠানো শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তান ও আমেরিকার ইন্টিলিজেন্স এটা পরবর্তীতে স্বীকার করে নেয় যে, রাশিয়ার সৈন্য প্রেরনের অন্তত ছয় মাস আগে থেকেই আমেরিকা গোপনে সব কট্টর মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুগামীদের একত্রিত করছিলো, ট্রেনিং দিচ্ছিলো।

ভাবতে পারেন ? আপনার যুদ্ধ, আপনার শত্রু — অথচ আপনার হয়ে যুদ্ধ করছে আরেক দেশের, আরেক জাতের, সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন আঙ্গিকের অপরিচিত হাজার হাজার মানুষ। শীতল যুদ্ধের বাস্তবতা যে কতোটা নিষ্ঠুর তা আফগানিস্তান না থাকলে আমরা হয়তো জানতামই না।

ওয়াশিংটন ডিসিতে সিআইএ মেসেজ দিলো, “We draw the Russians into the Afghan trap.” ব্রেজেন্সকি লিখলেন প্রেসিডেন্ট কার্টারকে, ” We now have the opportunity of giving to the USSR its Vietnam War.” ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ প্রায়।

আমেরিকা হাত করে নিলো প্রায় সবাইকে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে জিয়াউল হকের আইএসআই কে দিয়ে “ওয়ার্কিং ডাংকী”র কাজ করালো CIA এর তদবিরে। আমেরিকা কোন সময় কাছে এলো না। সারা পৃথিবীর যেকোনো যায়গা থেকে ইসলামের জিগির তুলে যুদ্ধের জন্য মুজাহিদদের তৈরি করা হলো। টাকা, অস্ত্র, খাদ্য, বাসস্থান সবকিছু পেছনে থেকে আমেরিকা, চীন, বৃটেন দিয়ে গেলো। মোট তেত্রিশটির উপর দেশ ও উগ্রবাদী ইসলামি দল এই দশ বছরের ধ্বংসযজ্ঞের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল।

কোন দেশই তখন উগ্রবাদী ইসলামি দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে মাথাব্যথা দেখায় নি। তাদের চোখে তখন শুধু শীতল যুদ্ধের পেরানোইয়া ! দুঃখের ব্যপার হলো, এই ট্রেনিং পাওয়া বুনো মানসিকতার প্রকাশ ই কিন্তু নিদারুণ ভাবে ঘটে গিয়েছিলো আমেরিকার উপর, ৯/১১ ! তাতেই সুত্রপাত হয়েছিল আফগানদের তৃতীয়বারের মতন কুড়ি বছরের ধ্বংস ও পরাধীনতার । যাইহোক, আমেরিকার বিশিষ্ট মিলিটারি ইতিহাসবিদ কোলির ভাষায়, “Cooley described the operation, and its dogma in this way: Virtually all would be Muslim. They would fervently believe that God had commanded them to fight His enemies, the Godless Communists and foreign Russian invaders. Their earthly rewards would be glory and generous pay. For those who died as martyrs, reward would be in heaven.”

দশ বছরের যজ্ঞে পোড়া গেছে এক লক্ষ আফগান নাগরিক। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে প্রায় তিন লাখ লোক। আঠারো হাজারের উপর রাশিয়ার সৈন্য নিহত হয়েছেন। আমেরিকা শুধু ১৯৮৭ তেই খরচ করেছে এই যুদ্ধের জন্য ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মুজাহিদদের মধ্যে বাটোয়ারা করেছে ৬৫০০০ টন অস্ত্র ! এই যুদ্ধের ধাক্কা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইউএসএসআর গর্ভাচেভের হাত ধরে রাশিয়ার দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

১৯৮৮ তে এক সাক্ষাৎকারে ব্রজিজিনস্কি কে জানতে চাওয়া হয়, তিনি ইসলামিক উগ্রবাদী সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ দেয়া, অস্ত্র সরবরাহ করে অনুতপ্ত কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, “Which was more important in the world history? The Taliban or the fall of the Soviet empire? A few over-excited Islamacists or the liberation of Central Europe and the end of the War?” বোঝো কান্ড !

১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯, শেষ সোভিয়েত সৈনিকটি যখন আমুদরিয়ার উপর দিয়ে আফগানিস্তান থেকে ফেরত চলে যায়, তখনও কাবুলিওয়ালারা জানতোই না যে তারা হয়তো নিতান্তই অভিশপ্ত ! এতোখানি লেখায় আমি কিন্তু তালিবানের উচ্চারণ একবারও করিনি। তালিবান এসেছে ১৯৯৪ এ। পাকিস্তান, চীন, আর আমেরিকার রেখে যাওয়া সুপার ট্রেইনড কিলারদের আবিষ্কার এই পাস্তুন ছাত্র সংগঠন। পাকিস্তানে তৈরি।

কাবুলে বধ্যভূমি। সেই কাবুল, কাজ শেষ হয়ে গেলে যার দিকে ফিরেও তাকায় না আমেরিকা, রাশিয়া, চীন। স্থানীয় ওয়ার লর্ডদের পপি(অপিয়াম),অস্ত্র, ইন্টারন্যাশনাল আর্থিক সাহায্য নিয়ে মারামারির ফাকে আফগানিস্তানের মাটিতে গজিয়েছে বিষবৃক্ষ তালিবান। পাকিস্তান আর চিনের ছত্রছায়ায় বিশ্বের সর্বত্র এখন শুধু একটা বিষয়ই রপ্তানি করবে কাবুল, নিদারুণ উগ্রবাদ। ওই মাটিতে আর কিছু গজায় না। আফগানিস্তানে সকল ইতিবাচকতার শিরোচ্ছেদ হয়ে গেছে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *