তৃণমূলের জয়ে উৎফুল্ল বাংলাদেশের ইসলামিক সংগঠন, শঙ্কিত হিন্দু নেতারা

কিশোর সরকার 

ঢাকা, ২১ জুন (হি.স): পশ্চিমবঙ্গে আবারও প্রত্যাবর্তন হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। বাংলাদেশের প্রতিবেশী, ভারতের এই রাজ্যে তৃণমূলের জয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামিক দল ও সংগঠন। বিভিন্ন ইসলামিক দলের পক্ষ থেকে তৃণমূলকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে, পাশাপাশি বাংলাদেশের ইসলামিক দল, ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষক, হাফেজ, মাওলানাদের মতে, তৃণমূলের জয় আসলে ধর্মনিরেপেক্ষতার জয়। তৃণমূলের জয়ে মুসলিমরা খুশি হলেও, অবশ্য একেবারে উল্টো সুর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে যাঁরা নিরন্তর সংগ্রামরত, এমন সনাতন ধর্মালম্বী দলগুলির নেতারা বলেছেন, তৃণমূলের জয়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আরও প্রকট হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ইসলামিক জঙ্গিদের অভয়াশ্রম হয়ে উঠবে, জঙ্গিবাদের উত্থান দুই দেশের শান্তিকামী নাগরিকদের শান্তি ভঙ্গ করবে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া হরকতুল জেহাদ-সহ ইসলামিক জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতারির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন হিন্দু নেতারা।  

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশের ইসলামিক দলগুলি খুশি হলেও, হিন্দু নেতারা মোটেও খুশি নন। বরং তাঁদের আশঙ্কা, পশ্চিমবঙ্গ জঙ্গিদের আশ্রয়স্থলে উন্নীত হবে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের পুনরায় জয়ে কী মনে করছে বাংলাদেশের ইসলামিক দলগুলি, সে বিষয়ে বিভিন্ন ইসলামিক দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বহুভাষী সংবাদ সংস্থা ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি কিশোর সরকার। ইসলামিক নেতাদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু হিন্দু নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছে হিন্দুস্থান সমাচার। 

                                                                            ইসলামিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া           

মমতার ধর্মরিপেক্ষতায় আস্থাশীল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ : ওয়াহিদুজ্জামান

মাওলানা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান : পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের জয়কে কীভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাওলানা সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের রক্ষাকবচ। শুধুমাত্র ভারত নয় ইসলামের মূল মন্ত্রও তাই। সমস্ত মানুষকে সমান অধিকার দিতে হবে, রাষ্ট্র সেটা নিশ্চিৎ করবে।” ওয়াহেদুজ্জামান বলেন, “পৃথিবীতে ইজরায়েল ছাড়া কোনও ধর্মভিত্তিক দেশ নেই। সৌদি আরবও ধীরে ধীরে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে ফিরে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে দেওবন্ধী আলেম-ওলামা দেওবন্ধের জয় হয়েছে। ভারতের সৃষ্টির পর থেকে দেওবন্ধী ইসলামিক আলেম-ওলামারা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য কাজ করছেন। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্মরিপেক্ষতার প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আস্থা রেখেছেন। তৃণমূলের এই জয় শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, ভারতের পরবর্তী কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিশ্ব মানবতার কাজে আসবে। আমরা বাংলাদেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাই।”

মমতার কাছ থেকে শিখতে হবে ধর্মনিরপেক্ষতা : আতেকী

পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলা’ ও তৃণমূলের পুনরায় জয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারী জেনারেল (মহাসচিব) হাফেজ মাওলানা আতিকুর রহমান আতেকী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য মাওলানা সিদ্দিক উল্লাহ বৈঠক করিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেশপ্রেমের কথায় শুনে অভিভূত হয়েছিলেন। তাঁর মতে, ধর্মনিরেপক্ষেতা যদি শিখতে হয়, তা মমতা দিদির কাছ থেকে শিখতে হবে। মাওলানা আতেকী বলেন, পশ্চিমবঙ্গে ৯০ হাজার মসজিদ আছে। এর মধ্যে অনেক মসজিদ সফর করেছেন তিনি। আর এই মসজিদের সকল ইমাম মোয়াজ্জেমরা দিদিকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আশীর্বাদ করেন। ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক যদি কেউ থেকে থাকেন, তাহলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ নন।

তৃণমূলের জয় ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষের জয় : মাদানী 

মাওলানা আনাস মাদানী : তৃণমূলের জয়কে ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষের জয় হিসাবে বর্ণনা করেছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা আহমেদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী। হেফাজতে ইসলামের কমিটি নিয়ে বিরোধ চলার কারণে আর কোনও মন্তব্য করেননি তিনি।

তৃণমূলের জয় সাধারণ জনতার ভোটাধিকার রক্ষার জয় : মাসউদ 

ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রাক্তন পরিচালক ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল উলামার সভাপতি মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় সাধারণ জনতার ভোটাধিকার রক্ষার জয়। নাগরিকরা সঠিকভাবে ভোট দিতে পেরেছেন বলেই এই বিজয় হযেছে। তৃণমূলকে পুনরায় জয়ী করায় পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন মাসুদ।

                                                                                 হিন্দু নেতাদের প্রতিক্রিয়া 

ভোট পরবর্তী হিংসা লজ্জাজনক : পলাশ কান্তি দে

ইসলামিক নেতাদের ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে। তৃণমূলের জয়কে ধর্মনিরেপক্ষেতার জয় মানতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, মাওলানা সিদ্দিক উল্লার ‘ওলামায়ে হিন্দ’-সহ ইসলামী দলের সঙ্গে জোট ও ইমাম ভাতা চালু করে তৃণমূল কংগ্রেস ধর্মরিপেক্ষতার যে ধ্বজা উড়িয়েছে সেটা প্রমাণিত। আবার পুরোহিত ভাতা চালু করে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনকে বোকা বানাচ্ছে। বাংলাদেশও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো ভোট বাণিজ্যের পথেই হাটছে। তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরে বাংলাদেশে যেভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপরে নির্যাতন হয়েছে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্ষণ, হত্যা, বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনের পরবর্তী এই ধরণের হামলা সত্যি লজ্জাজনক। তিনি আরও বলেন,  পশ্চিমবঙ্গকে ‘বাংলা’ নামকরণ করার ব্যাপারেও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশ নিয়ে বৃহত্তর ‘বাংলা’ করার স্বপ্ন। কিছু মানুষ অন্ধকার থেকে এ সব করাচ্ছেন। আমরা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। কারও দয়ায় নয়। তাই নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ গ্রাস করার চেষ্টা সফল করতে দেওয়া হবে এটা ভেবে নেওয়া ঠিক নয়।

পলাশ কান্তি-সহ বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বী দলগুলির অন্যান্য নেতারা বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান আরও প্রকট হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ইসলামিক জঙ্গিদের অভয়াশ্রম হয়ে উঠবে পশ্চিমবঙ্গ। ইসলামিক জঙ্গিবাদের উত্থান দু’দেশের শান্তিকামী নাগরিকদের শান্তি বিঘ্নিত করবে।