অশোক সেনগুপ্ত
কলকাতা, ২৬ এপ্রিল (হি. স.) : ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মমতার পছন্দের ১১ অফিসারের ভূমিকা। ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী গোড়াতেই যে ছয় অফিসারের কৃতিত্বের কথা বলেন তাঁরা হলেন, সস্তার চাল বিলির জন্য খাদ্যসচিব অনিল বর্মা, সাইকেল বিলির ব্যবস্থা করা এবং এসসি-এসটি শংসাপত্র বিলির জন্য অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ উন্নয়ন সচিব সঞ্জয় থাডে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য সমাজকল্যাণ সচিব রোশনি সেন, সংখ্যালঘু উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য দফতরের দুই প্রাক্তন সচিব খলিল আহমেদ ও পারভেজ বি সেলিম এবং রাস্তাঘাটের হাল ফেরানোর জন্য পূর্তসচিব ইন্দিবর পাণ্ডে। এছাড়াও তাঁর ’১৬-র জয়ে শিক্ষাসচিব বিবেক কুমার, পর্যটনসচিব অজিত বর্ধন, ক্ষুদ্রশিল্প সচিব রাজীব সিংহ এবং কৃষি দফতরের হাল ফেরানোর জন্য বর্তমান স্বাস্থ্যসচিব আরএস শুক্লের বিশেষ অবদান ছিল বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন। তাঁর মতে এই দফতরগুলির মাধ্যমে যে কাজ হয়েছে মানুষ তা উপলব্ধি করেছে এবং ভোটে তার প্রতিফলন মিলেছে।
একই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী সে সময়ে বলেন, ‘‘উন্নয়ন প্রকল্পগুলি সফল ভাবে পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। সেই কাজে অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীর বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে।’’ প্রবল চাপ এবং কষ্টের মধ্যেও দ্বিবেদী টাকা জোগাড় করেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন। আর সবার উপরে মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে তো ছিলেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচিব থাকাকালীন মলয়বাবুর অবদান স্বীকার করেন মুখ্যমন্ত্রী।
ওই আমলারা পরবর্তীকালে কোথায়, কী ধরণের দায়িত্ব পেলেন? গত ২ জুলাই ১৯৮৯ ব্যাচের আইএএস অনিল বর্মা হন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব। গত ২০ জানুয়ারি ’৯৩ ব্যাচের রোশনি সেন গণশিক্ষা ও গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতরের পাশাপাশি রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের প্রধান সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে গত ২২ মার্চ ফিরহাদ হাকিম পুর প্রশাসকের দায়িত্ব ত্যাগ করেন। কলকাতা পুরসভার দায়িত্ব দেওয়া হয় পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের সচিব অভিজ্ঞ আইএএস খলিল আহমেদকে। ১৯৮৮ ব্যাচের আইএএস ইন্দিবর পান্ডে ইতিমধ্যে চলে যান কেন্দ্রের ডেপুটেশনে। তাঁকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ সচিবের দায়িত্ব পান। গত ৭ এপ্রিল তাঁকে কেন্দ্রে প্রশাসনিক সংস্কার, জন অভিযোগ ও পেনশন দফতরের সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি পছন্দের আমলা ছিলেন ১৯৯০-এর আইএএস বিবেক কুমার। অত্রি ভট্টাচার্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর থেকে অপসারিত হওয়ার পর সুভদ্র বিবেকবাবুকে ওই দফতরের দায়িত্ব দেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর তাঁকে নিয়ে আসেন স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব করে। ২০২০-তে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব হন দু’জন অভিজ্ঞ আইএএস মনোজ অগ্রবাল এবং সুব্রত গুপ্ত। তাঁদের কাজে আস্থা রাখতে না পেরে অন্য বিভাগে সরিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাস্থ্যসচিব করে নিয়ে আসেন বিবেক কুমারকে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব প্রীতি সুদন ২০২০-র ৩০ এপ্রিল রাজ্যকে চিঠিতে জানান, কেন্দ্রের তালিকায় বঙ্গে রেড জ়োনের সংখ্যা চার থেকে বেড়ে হয়েছে ১০। প্রতিবাদ জানায় রাজ্য। প্রতিবাদপত্রে রাজ্যের করোনা-রোগীর সবিস্তার তথ্য দিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব বিবেক কুমার জানান, রেড ও অরেঞ্জ জ়োনে পশ্চিমবঙ্গে ‘কেস রিপোর্ট’ হয়েছে মোট ৯৩১টি! অথচ ৩০ এপ্রিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের মেডিক্যাল বুলেটিনে জানানো হয়, ওই দিন রাজ্যে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭২! এই নিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সরব হয় বিরোধী শিবির। ওই মেডিক্যাল বুলেটিনে থাকা ‘অ্যাক্টিভ কোভিড কেস’, সুস্থ হয়ে ছাড়া পাওয়া এবং করোনা-কারণে অথবা কো-মর্বিডিটি বা অন্য রোগভোগে মৃতের সংখ্যার যোগফলের সঙ্গে কেন্দ্রে পাঠানো রাজ্যের করোনা-তথ্যে কেন অমিল, সেই প্রশ্ন ওঠে। বিড়ম্বনায় পড়ে রাজ্য সরকার সংশোধিত তথ্য দেওয়ার কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। বরং তার পর থেকে স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিনের ধরন যায় বদলে।
রাজ্যে করোনা-রোগীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের আবহে সরে যেতে হল বিবেক কুমারকে। তবু অন্য দফতরে বদলির প্রাক্-মুহূর্তে গানের সুরে যেন নিজের কথাই বলে গেলেন স্বাস্থ্যসচিব বিবেক কুমার। স্বাস্থ্য ভবনে তাঁর বিদায় সংবর্ধনায় ছিলেন অনেক প্রশাসক-চিকিৎসক। সুগায়ক বিবেক কুমার সেখানে ধরলেন কিশোরকুমারের গান, ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারোঁ, না ঘর হ্যায় না ঠিকানা…।’
এবার স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিব হন ১৯৯৮ ব্যাচের আইএএস পরিবহণ দফতরের প্রধান সচিব এন এস নিগম। এর পর বিবেকবাবুকে পাঠানো হয় ওয়েষ্ট বেঙ্গল ভ্যালুয়েশন বোর্ডের চেয়ারম্যান। আমলাদের কাছে এই পদটা মোটেই সম্মানজনক নয়।

