স্নেহাশিসের হ্যাটট্রিক না দেবজিতের অভিষেক, উত্তর খুঁজছে জাঙ্গিপাড়া

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা, ৫ এপ্রিল (হি.স.): ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি-র শ্রীরামপুর কেন্দ্রের প্রার্থীর নাম শুনে অনেকের কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছিল। তৃণমূল প্রার্থী ওজনদার আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ওই কেন্দ্রের সাংসদও বটে, তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনও নামী প্রার্থী দিতে পারল না বিজেপি? কিন্তু ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল নির্বাচনে নবাগত ওই অনামী বিজেপি প্রার্থী দেবজিৎ সরকার অত্যন্ত ভাল ভোট পেয়েছেন। একটা দীর্ঘ সময় ধরে এলাকাগুলি সিপিএমের দুর্গ বলেই পরিচিত ছিল। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে এখানে তৃণমূলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই আধিপত্যে এখন ভাগ বসিয়েছে বিজেপি। তাই সম্ভবত ভোটের আগে মানুষের নীরবতায় বাড়তি সতর্ক হতে হচ্ছে নেতা-নেত্রীদের। জেলা রাজনৈতিক মহলের মূল্যায়ন, ‘কাজ-অকাজ’-এর দাঁড়িপাল্লায় কার পাল্লা ভারী, তার উপরেই প্রধানত নির্ভর করবে এই এলাকার ভোটের ফল। লোকসভার গত ভোটে কল্যাণবাবু জয়ী হন প্রদত্ত ভোটের ৪৫.৫০ শতাংশ পেয়ে। সেখানে দেবজিৎবাবু পান প্রায় ৩৯ শতাংশ (৫ লক্ষ ৩৯ হাজার ১৭১) ভোট। অনেক ব্যবধানে কংগ্রেস পায় ৬.২৯ শতাংশ।
দেবজিৎ সরকারকে এবার বিজেপি প্রার্থী করেছে জাঙ্গিপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন ৪৪ বছরের এই আইনজীবী। জন্ম ভুবনেশ্বরে। ডঃ বাসুদেব সরকার ও ডঃ ইন্দ্রাণী সরকারের একমাত্র পুত্র দেবজিৎ শৈশবের অনেকটা সময় উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর এবং মধ্যপ্রদেশে কাটিয়ে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সপরিবারে স্থায়ীভাবে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। প্রথমে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মিশন স্কুল ও তারপর কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজিয়েট স্কুলেই দেবজিতের শিক্ষাজীবন। ১৯৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর দেবজিৎ ২০০০ সালে আইন পাশ করেন। গত ১৭ বছর ধরে দক্ষ আইনজীবী হিসাবে প্রধানতঃ আলিপুর এবং শিয়ালদহ আদালতসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আদালতে তাঁকে সাফল্যের সঙ্গে সওয়াল করে এসেছেন।
অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময়েই যোগাযোগ হয় সংঘ পরিবারের সঙ্গে। দেবজিৎ সরকারের সামাজিক চেতনার প্রাথমিক উন্মেষ ঘটে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কাছাকাছি আসার মাধ্যমে সংঘের বিভিন্ন কাজকর্মের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমে সংঘের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বয়ংসেবক হিসাবে স্বীকৃতি পান। কাজ করেন কলকাতা মহানগরের উল্টোডাঙা শাখায়। গঠনায়ক থেকে মুখ্যশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করার পর, বারুইপুর নগর বৌদ্ধিক প্রমুখ দায়িত্বে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। এরপর সংঘের পূর্ণকালীন বিস্তারক হিসেবে বারাসাত, বসিরহাট ও বজবজে সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজে নামার অভিজ্ঞতা। ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতির আঙিনায় তাঁর প্রবেশ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কলকাতা মহানগর শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। রাজ্য কর্মসমিতির সদস্যপদে উত্তরণ হয়। এর পর ভারতীয় অধিবক্তা পরিষদের রাজ্য কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি যোগ দেন৷ পরিষদীয় রাজনীতির মূল ধারায় তাঁর প্রবেশ। ভারতীয় জনতা পার্টির আইন শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। এর পরে বিজেপি-র যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক এবং রাজ্য সম্পাদক,  ক্রমে মোর্চার রাজ্য সভাপতির দায়িত্বে।
সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেবজিৎ সরকার বিজেপি-র প্রতিনিধি হিসাবে বারবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য
২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করেন। তাঁর দায়ের করা একটি বিতর্কিত মোকদ্দমায় জেতেন। বিজেপি-র রাজ্য যুব মোর্চার সভাপতি হিসাবে ‘রাজ্য সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে’ রাজ্যের মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠের প্রতীক হিসাবে একটি বাইকযাত্রা সফলভাবে পরিচালনা করেন। উচ্চ আদালতের বিচারবিভাগীয় নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে দক্ষিণে কাঁথি থেকে উত্তরে কোচবিহার পর্যন্ত হয় ওই যাত্রা।
২০১৮ সালে উত্তর দিনাজপুর জেলার দাড়িভিটে তিনটি ছাত্র মারা যায়। দেবজিতের কথায়, “বর্তমান রাজ্য সরকারের বন্দুকপন্থী ক্ষমতার ঔদ্ধত্য, অতিসক্রিয়তা এবং সর্বোপরি ভাষা ও ধর্মীয় বিভাজনমূলক রাজনীতির জেরে অকালে ঝরে যায় ওই তিন নিরীহ প্রাণ। সেইসময়ে রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের নিষেধ ও রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজে নিহত ছাত্রদের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রায়গঞ্জ ও ইসলামপুরের মানুষকে নিয়ে আমরা বৃহত্তর এক প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করি। সেই সূত্রে উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে এক ঐকান্তিক ভালবাসার জায়গা করে নিই।”
আকর্ষণ করার মত দুর্নিবার রুপোলী জগতের গ্ল্যামার নেই। যথেষ্ঠ অভাব পৃষ্ঠপোষকতাজনিত প্রভাব-প্রতিপত্তিরও । কিসের ভিত্তিতে ভোটদাতার কাছে মান্যতা পাবেন? দেবজিতের উত্তর, “সারদা আর নারদ কেলেঙ্কারির মত আর্থিক দুর্নীতির জগতের অপবাদ একদম স্পর্শ করেনি, এটা একটা ইতিবাচক দিক। বিজেপি আক্ষরিক অর্থেই পরিবারতন্ত্র বা পাইয়ে দেবার তত্বে নয়, বরং কর্ম ও গুণের ভিত্তিতে নরেন্দ্র মোদীজির স্বপ্নে বিশ্বাসী। অনুভব করি তাঁর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ তত্ত্ব।” জাঙ্গিপাড়া এবং সংলগ্ন এলাকাগুলি আলুতে যতটা সমৃদ্ধ, ততটাই আলোচিত এখানকার রাজনীতি। কালো পিচ-রাস্তার দু’ধারে একরের পর একর জমিতে আলু তোলার কাজ প্রায় শেষ। সেই আলু এখন হিমঘরে পৌঁছনোর কাজ চলছে। রাজ্যের আলুচাষের এই ভরকেন্দ্রে দাঁড়ালে রোদের আঁচ যতটা গায়ে লাগে, ভোটের গরম ততটা মালুম হয় না। দেওয়াল লিখন না দেখলে বোঝার উপায় নেই ‘খেলা’ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাইকেলে আলুর বস্তা চাপিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক কৃষকের মন্তব্য, ‘‘গায়ে-গতরে খাটার পরে অত ভাবার সময় কোথায়?’’
২০০৬-এর বিধানসভা ভোটে জাঙ্গিপাড়ায় জেতেন সিপিএম-এর সুদর্শন রায়চৌধুরী। রাজ্যের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী হন তিনি। ‘১১-র নির্বাচনে তাঁকে হারিয়ে দেন ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার তৃণমূলের স্নেহাশিস চক্রবর্তী। স্নেহাশিস পান প্রদত্ত ভোটের ৫০.৫৪ শতাংশ। সিপিএম এবং বিজেপি-র ঝুলিতে পড়ে যথাক্রমে ৪২.৯৫ এবং ৩.২৮ শতাংশ। ‘১৬-র ভোটে স্নেহাশিস পান নিকটতম সিপিএম প্রার্থীকে হারিয়ে দেন ২৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে। তৃণমূল যেখানে  ৯৯,৩২৪ ভোট পায়, বিজেপি পায় মাত্র ১৩,৭১৬ ভোট। অঙ্কের এত ব্যবধান, তাহলে লড়াইটা এবার হবে কিসের ভিত্তিতে?
দেবজিতের উত্তর, “প্রচারে বেড়িয়ে মানুষের আর্তি বুঝতে পারছি। অনেকেই এবার একটা পরিবর্তন চাইছে। তাতেই আশা দেখা দিয়েছে। আগে নানা সময়ে পরীক্ষার নানা ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছি। সময়ই সব কিছুর উত্তর দেবে!“ জেলায় বিজেপি’র সাংগঠনিক সভাপতি গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “যত সুবিধা কেন্দ্র দিতে চাইছে, রাজ্য তাতে বাধা দিচ্ছে। ফলে ডাবল-ইঞ্জিন সরকার চাইছে মানুষ। জোটকেও প্রত্যাখ্যান করছেন ভোটাররা। মানুষ বোঝেন, তেল-গ্যাসের দাম এখন কিছুটা বেশি থাকলেও তা কমে যাবে। আমাদের লক্ষ্য মানুষকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেওয়া।” স্নেহাশিসের হ্যাটট্রিক না দেবজিতের অভিষেক— এর উত্তর খুঁজছে জাঙ্গিপাড়া। জাঙ্গিপাড়ার ভোট নির্বাচনের তৃতীয় পর্যায়ে, ৬ এপ্রিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *