সবংয়ে অগ্নিপরীক্ষা মানসের, কোনও খামতি রাখছেন না পোড়খাওয়া এই নেতা

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা, ৩১ মার্চ (হি.স.): পরম বন্ধুও মানস ভুঁইয়াকে মাথা ঠান্ডার লোক বলে প্রশংসা করতে পারবেন না। আবার পরম শত্রুও স্বীকার করতে দ্বিধা করবেন না রাজনৈতিক সাফল্যের নিরিখে মানসবাবু সত্যিই উৎকর্ষ নেতা। এবার তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। প্রচারে বেরিয়ে মাত্র কয়েকদিন আগে শিরোনামে এসেছেন এই রাগী রাজনীতিবিদ। আবাস যোজনার বাড়ি কেন পাওয়া যায়নি, এ নিয়ে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে দলেরই এক কর্মীর কাছে প্রশ্ন করেন মানস। সদুত্তর না পেয়ে জনসমক্ষেই চড় মারেন ওই কর্মীকে। এ ভিডিও ভাইরাল হয়ে যেতে, মানস বলেন, দলীয় কর্মীদের শাসন করার অধিকার নেতাদের রয়েছে। অন্যদিকে, প্রচারে বেরিয়ে এভাবে মেজাজ হারানোকে আত্মবিশ্বাস হারানোরই প্রমাণ বলে দাবি করছে বিরোধীরা। আবার, বহুভাষী সংবাদ সংস্থা “হিন্দুস্থান সমাচার” ক’দিন আগে যখন ফোনে কথা বলছেন মানসবাবুর সঙ্গে, তাঁর কাছে ওপ্রান্তে অপর ফোনে একজন একটু কথা বলতে চাইলেন। যে তেজের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন মানসবাবু, আমার হাত থেকেই মুঠোফোন পড়ে যাওয়ার যোগাড়। 

খুব সচেতন না থাকলে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ বা ঝানু সাংবাদিকও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে দলের নাম ভুল করে ফেলতে পারেন। বাম আমলে তাঁর জয় কখনও কেউ কাড়তে পারেনি। বর্ণময় সেই মানস ভুঁইয়া ১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত কংগ্রেসের হয়ে আসন জিতেছেন তিনি। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে বললেন, “সিপিএম আমাদের ধান-জমি লুঠ করেছিল।” ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গঠনের পর, সেই মন্ত্রিসভায় তাঁকে একাধিক দফতর দেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস মমতা সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। মানস ভুঁইয়া, ডক্টর মানস ভুঁইয়া দল বদলান। এর পর তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠায় তৃণমূল। হলেন সাংসদ।” 

বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁকে নাম না করে সবংয়ের সভায় রাবণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পালটা সভায় শুভেন্দুবাবুকে ‘খোকাবাবু’ তকমা দিয়েছেন মানস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী মানস ভুঁইয়া সম্পর্কে বলেছেন ‘বুড়ো গরু’। আর মানসবাবু নিজের তুলনা করেছেন নিজেকে দিয়েই। ২০১৬-র মাঝপর্বে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে নারাজ মানস ভুঁইয়ার সঙ্গে দল নেতাদের প্রকাশ্য বিরোধ হয়। বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করে কংগ্রেস। কেন তাঁর সম্মানহানি করল দল, এনিয়ে আবদুল মান্নানের সঙ্গে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে মানস ভুঁইয়ার। মানসবাবু এনিয়ে সনিয়া গান্ধীর সহযোগিতা চান। এই প্রতিবেদককে বললেন, “৪৮ বছর কংগ্রেস করেছি। জগাই-মাধাই, মানে অধীর-মান্নান (বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান) আমাকে সাসপেন্ড করে দল থেকে তাড়ায়। কারণ, আমি সুজন চক্রবর্তীকে পিএসি-র পদে যেতে দিইনি। আমার রাজনীতির পরীক্ষা কাউকে দিতে হবে না।”

রাজনীতির হাতেখড়ি কীভাবে? মানসবাবুর কথায়, “১৯৬৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হলাম কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিন মাস বাদেই তা ছেড়ে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে। ওই সময় থেকেই রাজনীতির আঙিনায়। ১৯৮২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ডাকে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলাম। একবারই হেরেছিলাম ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে। ৪২টা বুথে সিপিএম বন্দুক দেখিয়ে সেবার ভোট লুঠ করেছিল। ’৮২ থেকে ’৯৬, তার পর ২০০৩ থেকে ‘১৭-র ২৪ জুলাই পর্যন্ত ছিলাম বিধায়ক। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলাম ২০১০-এর ২৩ আগস্ট থেকে ’১১-র ১৭ জানুয়ারি। ’১২-তে কিছু সময়ের জন্য সেচ জলপথ, ক্ষুদ্র শিল্প ও বস্ত্র দফতরের মন্ত্রী। সাংসদ হই ২০১৭-র ১৯ আগস্ট।“ এর পর সবং আসনে ভোটে জেতেন তাঁর স্ত্রী গীতারানি ভুঁইয়া। 

একঝলক দেখা যাক কীভাবে বদলিয়েছে সবংয়ের ভোটচিত্র। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে সবং কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে ৫১.২৫ শতাংশ ভোট পান মানসবাবু। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল যথাক্রমে বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস (বিবিসি) এবং বিজেপি। বিজেপি পায়  মাত্র ১.৩ শতাংশ ভোট। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে সবং কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে ৫৯.৭০ শতাংশ ভোট পান মানসবাবু। বিজেপি পায়  মাত্র ২.৬০ শতাংশ। ’১৭-র উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী গীতারানি ভুঁইয়া পান ৫১.২১ শতাংশ ভোট। ২য় ও ৩য় হয় বিবিসি এবং বিজেপি। বিজেপি-র শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮.০৮। কংগ্রেস পায় চতুর্থ স্থান। এই সংখ্যাতত্ব বলে দিচ্ছে সবংয়ে ভুঁইয়াদের প্রভাবের মাত্রা কতটা। সেটা খোলা গলায় স্বীকারও করেছেন মানসবাবু। কিছুদিন আগে তিনি ‘আইকোর’ চিটফান্ড-কান্ডে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সমন পেয়েছিলেন। তাঁর দাবি, গোটা বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভোটে তার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না।” কিন্তু এবারের ভোটে ফল কী হবে? জবাব, “আমিই জিতব!” কী কারণে? মানসবাবু বলেন, “গত লোকসভা নির্বাচনে ওই যে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের বাড়তি শতাংশ দেখছেন, ওটা মূলত সিপিএমের ভোট ছিল। এবার বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন অমূল্য মাইতি। উনি তৃণমূলে থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলেন। টিএমসি-র ৮-৯ হাজার ভোট উনি লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-তে এনেছিলেন। এবার একেবারে শেষ মুহূর্তে উনি বিজেপি-তে যোগ দিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু ভোটে আমিই জিতব।” মুখে যে দাবিই করুন, চড়া রোদ্দুরেও প্রচারে খামতি রাখতে চাইছেন না পোড়খাওয়া এই নেতা। সবংয়ে ভোট দ্বিতীয় দফায়, ১ এপ্রিল। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *