ইরফানের মৃত্যুতে কিছুর প্রশ্ন রইল মুসলমানদের প্রতি

আর কে সিনহা

একদিকে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর দাপট অন্যদিকে ইরফান খান ও ঋষি কাপুর এর মতন প্রথিতযশা বলিউড অভিনেতাদের প্রয়াণে শোকের অতলে তলিয়ে গিয়েছে দেশবাসীর মন। দুজনেই অসাধারণ শিল্পী ছিলেন। দু’জনেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে হিন্দি চলচ্চিত্রে নিজেদের ছাপ রেখে গিয়েছেন।

ভাল অভিনেতা হওয়ার পাশাপাশি একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ ছিলেন ইরফান খান। খুব ভেবেচিন্তে কোন বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করতেন তিনি। যদিও তিনি সাধারণত চলচ্চিত্র জগতের বাইরে অন্যান্য বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন না। কিন্তু যখন বলতেন তখন সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনত। বাকি তারকাদের থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। আসলে তিনি একজন শিল্পী ছিলেন, তারকা নন। তিনি নিজেকে “ধর্মনিরপেক্ষ” বলে প্রতিপন্ন করার আকাঙ্ক্ষা কখনও করেননি। তিনি ভারতে থাকতেও কোনওদিন ভয় পাননি।এমনকি কখনও ‘মাই নেম ইজ খান’ এর তকমাও খাড়া করেননি । অন্ধকার জগতের টাকায় ফুলে-ফেঁপে ওঠার বাসনাও নিজের মনে কখনও জন্মাতে দেননি। যেসকল চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন তাতে তিনি মিলে মিশে গিয়েছিলেন।পিকু, লাঞ্চ বক্স, মকবুল, হিন্দি মিডিয়ামের মতো তাঁর ছবিগুলি দেখে মনে হয় প্রতিটি চরিত্রই তাঁর জন্য তৈরি হয়েছিল।তিনি সারা জীবন প্রকৃত অর্থেই সত্যিকারের শিল্পী ছিলেন।

ইরফান কখনও নিজের স্বার্থের জন্য ধর্মের কার্ড খেলেননি।নিজের ইসলাম ধর্মকে তিনি যেভাবে সম্মান দিতেন।তেমনি প্রতিটি ধর্মকেই একইভাবে সমীহ করতেন। তিনি কখনও হিন্দু দেবদেবীদের অপমান করেননি।তিনি কখনও পুরষ্কার ফেরত দেওয়া গ্যাংয়ের সদস্য ছিলেন না।তিনি সর্বদা একজন সত্যিকারের শিল্পী হিসাবে থেকে গিয়েছেন।ইরফান খানের মৃত্যুতে শোকের ঢেউ উঠে গিয়েছে।যা থামবার নাম করছে না। তিনি সত্যিই দেশকে ভালোবাসতেন।

ইরফানের অভিনয় ক্ষমতা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি ভারতবাসীকে প্রভূত আনন্দ দিয়ে গিয়েছেন নিজের শিল্পকলার মধ্যে দিয়ে। ভারতের শ্রমজীবী মানুষের মুখে নিজের অভিনয় দিয়ে সুখ এনে দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার পদবী খান এবং তিনি জাতে মুসলমান হওয়া নিয়ে একেবারেই চিন্তিত ছিলে না ভারতবাসী।এই দৃষ্টিকোণ বোঝাটা জরুরী। ইরফান খানকে যে ভাবে দেশবাসী ভালবেসেছে তাতে মুসলমানদের বুঝতে হবে যে মানুষ ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে ভালবাসা বা ঘৃণা করে না।আপনি কি ভাবে দেশ এবং দেশবাসীর হিতের জন্য কাজ করে গিয়েছেন সেটাই দেখে দেশবাসী।আপনার সংস্কৃতি উর্দু, কওয়ওয়ালি, গজল এবং রন্ধন নিয়ে কারও কোনও আপত্তি নেই।কেউ তাজমহলকে ঘৃণা করে না। সমগ্র দেশ শহীদ আবদুল হামেদ ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে কালামকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকেন।তাকে দেশের নায়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।তাদের জন্য দেশ গর্বিত।কিছু দিন আগেও তো দাড়িওয়ালাদের থেকে সারা দেশে কারওই কোনও সমস্যা ছিল না।বোরকা পরা লোকদের কারও কোন আপত্তি ছিল না।
তবে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলেছে কারণ সম্প্রতি এই সকল দাড়িওয়ালারা অনেক অপকর্ম করেছে।শিখদেরও দীর্ঘ দাড়ি থাকে।তাদের নিয়ে কারও কোনও সমস্যা নেই।খ্রিস্টানদের পোশাকও কখনই কারও অসুবিধে হয়নি।খ্রিস্টান মিশনারীদের দেখলে শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়। একজন মুসলমানের দীর্ঘ দাড়ি এবং হিজাব দেখে কি একইরকম মনোভাব তৈরি হয়? আপনি কি মনে করেন যে দীর্ঘ দাড়িওয়ালা একটি পুরুষ এবং একটি হিজাব পরা মহিলা সমাজসেবায় নিযুক্ত থাকতে পারে? ইরফান খানের মৃত্যুর পর দেশের মুসলমানদের সেই অংশকে মেনে নিতে হবে যে কেউ তাদের ঘৃণা করে না।তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়।

ইরফান খানের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে।কিছু চলচ্চিত্র লেখক তাকে অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা নিজেদের জায়গায় সঠিক হতে পারেন।তবে নাসিরউদ্দিন শাহের মতো ইরফান ভারতকে কখনও ভয় পাননি। নাসিরউদ্দিন শাহকেও ভারতের কোটি কোটি সিনেমা প্রেমীরা গভীর ভাবে ভালবেসে গিয়েছে। তবে ভারতে থাকতে শাহ ভয় পান। ২৬ / ১১- মুম্বই হামলায় নাসিরউদ্দিন শাহ ভয় পাননি। এমনকি কাশ্মীরে যখন পণ্ডিতদের হত্যা করা হচ্ছিল তখনও নাসিরউদ্দিন শাহকে ভয় পাননি।নাসিরুদ্দিন শাহের মতো লোকরা কান খুলে শুনে নিক যে ভারতের নায়ক আব্দুল কালাম থেকে শুরু করে ইরফান খান এবং আজিম প্রেমজি থেকে আবদুল হামিদের মতো লোক থাকবে। দেশপ্রেম এবং জনসেবার কারণে তারা প্রকৃত দেশের নায়ক হয়ে উঠেছেন। এই দেশ কখনই জাকির নায়েক এবং তবলীগী জামায়াতের মাওলানা সাদকে নিজের নায়ক বলে মেনে নেয়নি। ভারতের রক্তে ধর্মনিরপেক্ষতা রয়েছে।মনে রাখতে হবে ভারতীয় বায়ু সেনার প্রধান ইদ্রিস হাসান লতিফ ছিলেন। তবে কিছু লোকের কাছে ভারতের সব খারাপ লাগে।এখানে আমি বলতে চাই যে, মুসলমানদের একটি অংশকে কিছু দেশবিরোধী শক্তি উসকে দিয়েছে।

এবার আসা যাক ঋষি কাপুরের প্রসঙ্গে। ববি, লায়লা মজনু, আমার আকবর অ্যান্টনি, মুলকের মতো তাঁর চলচ্চিত্রগুলি সমস্ত ধর্মের শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়েছে। পুরানো দিল্লির মুসলিম মহিলারা লায়লা মঞ্জনুর ছবি দেখতে জামা মসজিদ সংলগ্ন ‘জগত’ সিনেমা হলে পালকিতে করে দেখতে আসতেন। আসলে ভারতীয় সমাজ এবং সিনেমার চরিত্রটি মূল হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ।দুঃখের বিষয়, হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নেতিবাচক শক্তি এই কাজ করে থাকে। এমএফ হুসেন যখন দেবীর আপত্তিজনক চিত্র  এঁকেছিল । তখন অনেক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বলেছিল হুসেন কাজ নিষিদ্ধ করা উচিত নয়। ইরফান খান কখনও এ জাতীয় কাজ করেননি। সুতরাং, তাঁর মৃত্যুতে পুরো দেশ শোকে বিহ্বল সুতরাং এমএফ হুসেন এবং মওলানা সাদ নয়, ইরফান খান দেশের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। হিন্দুস্থান সমাচার / শুভঙ্কর
(লেখক বরিষ্ঠ সম্পাদক রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *