নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ৭ ডিসেম্বর৷৷ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব)-এর বিরোধিতা করে আগমী ৯ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুরা বনধ-এর ডাক দিয়েছে জয়েন্ট মুভমেন্ট অ্যাগেনস্ট সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল (সংযুক্ত কমিটি)৷ শনিবার আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে কমিটির কনভেনর এন্থনি দেববর্মা বনধ-এর ঘোষণা করেছেন৷ তিনি জানান, উপজাতিভিত্তিক আঞ্চলিক দল আইএনপিটি, এনসিটি, টিএসপি, ছাত্র যুব সংগঠন টিএসএফ, বিভিন্ন উপজাতি ছাত্র সমাজ, নাগরিক সমাজ, ক্ষত্রিয় সমাজ এবং বিভিন্ন এনজিও তাঁদের কমিটিতে রয়েছে৷ সর্বসম্মতিক্রমেই অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুরা বনধ-এর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷

এন্থনি দেববর্মার আহ্বান অন্য উপজাতিভিত্তিক রাজনৈতিক এবং জাতীয় দলও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরোধিতায় আহূত বনধ-এর সমর্থন করুক৷ সাথে তাঁর হুঁশিয়ারি, প্রস্তাবিত বনধকে ঘিরে ত্রিপুরায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে রাজ্য সরকারকে এর দায় নিতে হবে৷ এদিকে অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুরা বনধ-এর ঘোষণায় বিজেপি ভর্ৎসনা করে বলেছে, রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়েই তাঁরা এখন রাজ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে৷
সম্ভবত ৯ ডিসেম্বর লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করবে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তাই, ওইদিন থেকেই বিল-এর বিরোধিতায় অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুরা বনধের ডাক দিয়েছে সংযুক্ত কমিটি৷ আজ এন্থনি দেববর্মা জানিয়েছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে৷ বিলটি এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে৷ তাই এই বিলকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না৷
আইএনপিটি-র সাধারণ সম্পাদক বলেন, গতকাল সংযুক্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মা এবং কনভেনর এন্থনি দেববর্মা নিযুক্ত হয়েছেন৷ তিনি জানান, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সম্ভবত লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যাবে৷ কিন্তু, এই বিল থেকে ত্রিপুরাকে বাদ রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছিল৷ অথচ, তাঁদের দাবি না মেনে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদে বিল পেশ করতে চলেছে৷ তিনি এদিন সমস্ত আঞ্চলিক এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলিকে এই বিলের বিরোধিতায় বনধকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন৷
এনসিটি নেতা অনিমেষ দেববর্মা বলেন, ক্যাব লাগু হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বেন৷ তাই, ভূমিপুত্রদের স্বার্থে যাঁরা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম জারি রেখেছেন তাঁদের বনধের সমর্থনে এগিয়ে আসা উচিত৷ এক কদম এগিয়ে তিনি আইপিএফটি এবং বিজেপি জনজাতি বিধায়কদেরও ওই বিলের বিরোধিতায় এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, শাসকদলীয় জনজাতি বিধায়কদের অবিলম্বে পদত্যাগ করে সারা দেশের কাছে বার্তা দেওয়া উচিত৷ তিনি মনে করেন, জনপ্রতিনিধিরা পদত্যাগ করলে দিল্লি এই বিলের ভয়াবহতা অনুভব করবে৷
অনিমেষ দেববর্মা বলেন, ইনার লাইন পারমিট এবং ষষ্ঠ তপশিলভুক্ত এলাকাকে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর আওতার বাইরে রেখে জাতি-উপজাতির মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে কেন্দ্র৷ তিনি বলেন, ত্রিপুরা আন্তর্জাতিক সীমান্তঘেরা রাজ্য৷ এই রাজ্যে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটেছে৷ ফলে, এই রাজ্যকে ওই বিলের আওতার বাইরে রাখা একান্তভাবে উচিত৷
এদিকে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ছাত্র সংগঠনগুলির যৌথমঞ্চ নর্থ-ইস্ট স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন (নেসো)-এর রাজ্য নেতা জানান, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরোধিতায় ১০ ডিসেম্বর সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১১ ঘণ্টার বনধ ডাকা হয়েছে৷ নেসো ত্রিপুরায় অনির্দিষ্টকালের বনধকেও সমর্থন জানাচ্ছে৷ অনিমেষবাবু এদিন বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার এই বিল নিয়ে আলোচনায় এগিয়ে আসলে আমরা তাতে প্রস্তুত৷ কিন্তু, শুধু ষষ্ঠ তপশিল এলাকাকে এই বিলের আওতার বাইরে রাখা মেনে নেওয়া হবে না৷
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরোধিতায় ত্রিপুরা বনধ-এ গোটা রাজ্য স্তব্ধ হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এতে জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ কিন্তু, সংযুক্ত কমিটির সদস্যদের দাবি, মত প্রকাশের অধিকারের বলেই এই বনধ-এর ডাক দেওয়া হয়েছে৷ অন্যায় হলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবেই৷ তাতে একাংশের ভোগান্তি হবে তা অস্বীকার করছি না, বলেন এন্থনি দেববর্মা৷ তিনি জানিয়েছেন, বনধ-এর আওতায় সুকল, কলেজ, অফিস-আদালত থাকবে৷ তাছাড়া রাস্তা ও রেল অবরোধ করা হবে৷
এদিন জগদীশ দেববর্মা জানিয়েছেন, ৯ ডিসেম্বর থেকে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই বনধ পালন করা হবে৷ তবে, অতীতে বনধকে ঘিরে ষড়যন্ত্র হয়েছে৷ তাতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছিলেন৷ তিনি বলেন, গত ৮ জানুয়ারি নেসো-র ডাকা বনধকে বানচাল করার চক্রান্ত হয়েছিল৷ বিজেপির মদতপুষ্টরা ওই চক্রান্তে শামিল ছিলেন৷ ফলে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় পুলিশ গুলি ছুঁড়েছিল৷ তাতে কয়েকজন আহতও হয়েছিলেন৷
তিনি দাবি করেন, মাধববাড়ির ওই ঘটনায় শাসকদল যুক্ত ছিল৷ তাঁদের প্ররোচনায় পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল৷ তাঁর বক্তব্য, অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুর বনধ-এও ষড়যন্ত্র হলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়া স্বাভাবিক৷ এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে এর জন্য রাজ্য সরকারকে দায় নিতে হবে৷ তাঁর হুঁশিয়ারি, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কারোর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না৷
এদিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরোধিতায় অনির্দিষ্টকালের ত্রিপুরা বনধকে তিরস্কার করেছে বিজেপি৷ দলের প্রদেশ মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, রাজ্যের মানুষের কষ্টদায়ক কোনও আন্দোলনই মেনে নেওয়া যায় না৷ তাঁর কটাক্ষ, আহূত বনধ কাদের স্বার্থে তা আহ্বানকারীদের স্পষ্ট করতে হবে৷ তিনি ভর্ৎসনা করে বলেন, রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়েই এখন তাঁরা রাজ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে৷
অন্যদিকে, বামফ্রন্ট কমিটির চেয়ারম্যান বিজন ধর প্রস্তাবিত বনধকে সমর্থন করছেন না বলে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরোধিতা করে রাজ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়াকে সমর্থন করি না৷ তাঁদের এই ফালতু আন্দোলনের সাথে বামফ্রন্ট একমত নয়৷ সাথে তিনি শাসক জোটশরিক আইপিএফটিকে বিঁধে বলেন, এই বিলের বিরোধিতায় ১২ ঘণ্টার বনধ না করে মন্ত্রিসভা থেকে তাঁদের বেরিয়ে যাওয়া উচিত৷
অবশ্য কংগ্রেস নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরোধিতায় সংযুক্ত কমিটির ভূমিকাকে সমর্থন করেছে৷ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কনভেনার পীযূষকান্তি বিশ্বাস বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর বিরুদ্ধাচরণ করে আহূত আন্দোলনকে সমর্থন করছি৷ তাঁর কথায়, হয়ত সংযুক্ত কমিটি মনে করেছে ওই বিলের বিরোধিতায় চূড়ান্ত আন্দোলন হলেই কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসবে৷ সাথে তিনি জানিয়েছেন, ওই বনধকে সমর্থন করার বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে৷