নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১৬ অক্টোবর৷৷ রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম সর্ববৃহৎ ঘোটালার তথ্য সামনে এসেছে৷ বামফ্রন্ট আমলে পূর্ত দফতরে ২২৭ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার ঘোটালার হিসেব তুলে ধরেছেন সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক৷ কস্টপ্লাস বেসিসে মন্ত্রিসভায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হলেও, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ৩৫ থেকে ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি করে কাজের বরাত দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি৷ তাই প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী তথা বর্তমান বিধায়ক সিপিআিএম নেতা বাদল চৌধুরী, প্রাক্তন পূর্তকর্তা সুনীল ভৌমিক এবং পূর্ত দফতরের প্রাক্তন প্রধানসচিব তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিবের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, জানিয়েছেন সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক৷ তাঁর কথায়, রাজ্যের মানুষের টাকা লুট করে যত দুর্নীতি হয়েছে তা জনসমক্ষে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি৷ তাই, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় নয়, প্রতিশ্রুতি পূরণেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজ্য সরকার৷

বুধবার আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে সাংসদ প্রতিমা ভৌমিক বলেন, স্বচ্ছতা শুধু পরিবেশের নয়, সমাজেও স্বচ্ছতা আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিজেপি৷ তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ শুরু করেছে রাজ্য সরকার৷ তিনি বিদ্রুপ করে বলেন, কমিউনিস্টরা নিয়মানুযায়ী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক দুর্নীতিতে ওস্তাদ৷ তাঁদের দুর্নীতির কোনও প্রমাণ তাঁরা রাখেন না৷ কিন্তু নিষ্ঠা এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বামফ্রন্ট আমলের দুর্নীতির তথ্য কবর খুঁড়ে বের করেছে রাজ্য সরকার৷ তাঁর দাবি, ২০০৮ সালে ১৩টি কাজের বরাত দিয়ে ২২৭ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকার দুর্নীতি হয়েছে পূর্ত দফতরে৷ সমস্ত নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে ওই দুর্নীতিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তদানীন্তন পূর্তমন্ত্রী তথা বর্তমান বিধায়ক বাদল চৌধুরী, প্রাক্তন ইঞ্জিয়ানিয়ার-ইন-চিফ সুনীল ভৌমিক এবং পূর্ত দফতরের প্রাক্তন প্রধানসচিব তথা প্রাক্তন মুখ্যসচিব ওয়াই পি সিং৷ তাঁদের বিরুদ্ধে ভিজিলেন্স তদন্তে পূর্ত দফতরের ওই সময়ের দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে দুর্নীতির ছাপ পাওয়া গেছে৷ তাই ভিজিলেন্স তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ প্রাক্তন পূর্তকর্তাকে জালে তুলেছে, জানান তিনি৷ সাংসদ ভৌমিক কটাক্ষের সুরে বলেন, ওই দুর্নীতির টাকা ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম খরচ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছিল৷
এদিকে রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী রতনলাল নাথ বলেন, দীর্ঘ ২৫ বছরের শাসনে ২০০৮ সালে বামফ্রন্ট সরকার দিনে ডাকাতি করেছে৷ তাঁর দাবি, বিজেপি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কোনও কাজ করে না৷ কিন্তু কোনও দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দেয় না৷ তাঁর কথায়, ২০০৮ সালে ১৩টি কাজের প্যাকেজ করে বরাত দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার৷ পাঁচটি ব্রিজ, পাঁচটি বিল্ডিং এবং তিনটি রাস্তা নির্মাণের জন্য প্যাকেজ তৈরি করে কস্টপ্লাস বেসিসে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা৷ তাতে, স্থির হয়েছিল মোট কাজের ১০ শতাংশ বৃদ্ধি হিসেবে খরচ ধরা হবে৷ কিন্তু, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে মন্ত্রিসভাকে ঘুমে রেখে ৩৫ থেকে ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি ধরে কাজের বরাত দেয় বাদল চৌধুরীর পূর্ত দফতর৷ তাঁর দাবি, ৬৩৮ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার কাজ বেড়ে হয়েছিল ৮৬৬ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা৷ তাতে, ২২৭ কোটি ৬৭ লক্ষ অতিরিক্ত খরচ হয়েছে৷ রতন নাথের কথায়, দুর্নীতিতে এখানেই থেমে থাকেনি বাম জমানার পূর্ত দফতর৷ একই কাজের জন্য দুবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল৷ তা-ও শুধু বহিঃরাজ্যের ঠিকাদারি সংস্থাকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য, দাবি করেন তিনি৷
রতন নাথ দৃঢ়তার সাথে বলেন, পরিকল্পিতভাবে দরকষাকষি করার জন্যই ওই পন্থা নিয়েছিল পূর্ত দফতর৷ কারণ, সরকারি ঠিকাদারি সংস্থাকে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্ঢেম্বর থেকে ২৪ সেপ্ঢেম্বরের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল৷ পুনরায় ২২ সেপ্ঢেম্বর আবারো দরপত্র আহ্বান করা হয়, যেখানে বেসরকারি ঠিকাদারি সংস্থাকে ১৭ অক্টোবরের মধ্যে দরপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল৷ রতনলালের দাবি, ওই পদ্ধতির জন্য বেসরকারি ঠিকাদারি সংস্থা সামান্য কমিয়ে দরপত্র জমা দিয়েছিল৷ কারণ আগেই দর জেনে গেয়েছিল তারা৷ রতন নাথ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সম্পূর্ণ বদ-উদ্দেশ্যেই একই কাজের দুবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল৷
এদিন তিনি আরও জানান, ওই সময় ত্রিপুরা সরকারের মুখ্যসচিব শশী প্রকাশ সমস্ত বিষয় মন্ত্রিসভাকে অবহিত করার জন্য পূর্ত দফতরের তদানীন্তন প্রধানসচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ কিন্তু, মন্ত্রিসভাকে না জানিয়ে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য মুখ্যসচিবকে চাপ দিয়েছেন৷ অবশ্য, এ-সমস্ত বিষয় মুখ্যসচিব সরকারি ফাইলে নোট রেখেছেন৷ তাই, এত বড় জালিয়াতির বিষয়টি সামনে এসেছে৷ রতন নাথ এদিন জানতে চেয়েছেন, সমস্ত বিষয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে হয়েছে কীভাবে৷ তাঁর মতে, হয়ত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এ-বিষয়ে অবগত নন৷ নয়তো, সমস্ত কিছু তাঁর জ্ঞাতসারে হয়েছে৷ শুধুমাত্র পার্টি তহবিল স্ফীত করার জন্য তিনি চুপ থেকেছেন৷
রতনলাল নাথ জানিয়েছেন, ত্রিপুরায় সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর পূর্তমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লবকুমার দেব পুরানো সমস্ত ফাইল খুলেছেন৷ তাতেই ওই দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে৷ তাই তিনি ভিজিলেন্সকে ওই দুর্নীতির তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ তিনি বলেন, ভিজিলেন্স ওই দুর্নীতির অভিযোগে প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী তথা বাদল চৌধুরী, পূর্ত দফতরের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ সুনীল ভৌমিক এবং পূর্ত দফতরের প্রাক্তন প্রধানসচিব তথা প্রাক্তন মুখ্যসচিব ওয়াই পি সিংকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷ ওই দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ তাই এনসিসি থানায় একটি মামলাও হয়েছিল৷ অবশেষে ভিজিলেন্সের সাব ইন্সপেক্টর বাদল দত্ত গত রবিবার পশ্চিম আগরতলা থানায় ওই তিন জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ফৌজদারি দন্ডবিধি ৪০৯, ৪০৮, ৪২০, ২০১, ১২০বি এবং দুর্নীতি বিরোধী আইনের ১৩ ধারায় মামলা দায়ের করেছে৷ রতন নাথের কথায়, ওই মামলায় প্রাক্তন পূর্তকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন এবং প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন৷ তাঁর সাফ কথা, দুর্নীতির সাথে যুক্ত একজনকেও ছাড় দেওয়া হবে না৷ ত্রিপুরা সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে কার্পণ্য করবে না৷

