কংগ্রেস বাঁচানোর লড়াই

জাতীয় কংগ্রেসের দুর্দিন যে সহসা ঘুচিবে না সে সম্পর্কে বোধহয় রাজনৈতিক মহলে দ্বিমত নাই৷ বাম প্রভাবিত ত্রিপুরায় কংগ্রেস সহসা মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে এমন আশাও কেউ করিতেছে না৷ পশ্চিমবঙ্গে আগামী দিনে কংগ্রেসের অবস্থা আরও শোচনীয় হইবে৷ কারণ দলে চরম অনৈক্য৷ গত বিধানসভা নির্বাচনে পঃবঙ্গে বামেরা শোচনীয় ফল করে৷ সেই তুলনায় জোটের ফায়দা কংগ্রেস কিছুটা পাইয়াছে৷ বিধানসভার পাবলিক একাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান মানস ভুঁইয়া৷ ফলে বঙ্গ কংগ্রেসের হাল আরও শোচনীয় পর্য্যায়েই পৌঁছিয়াছে৷ কংগ্রেসের এই কলহে এক ঢিলে দুই পাখী মারিতেছে৷ এক, কংগ্রেস দূর্বল হইতেছে, অন্যদিকে বাম কংগ্রেস জোট টিকাইয়া রাখাও কঠিন হইয়া পড়িয়াছে৷ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির রেশ কোন্ দিকে মোড় নিবে তাহা তো এখনই বলা যাইবে না৷ তবে, কংগ্রেস বাম জোটের ঐক্য কতদিন ধরিয়া রাখা যাইবে সেই প্রশ্ণও এখন তীব্র হইয়াছে৷ এমনিতেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট নিয়া সিপিএম শীর্ষস্তরে জোর সংঘাত জারী আছে৷ এই অবস্থার মধ্যে পিএসি চেয়ারম্যান পদ নিয়া যেভাবে সুজনবাবুদের বেইজ্জত হইতে হইয়াছে তাহা ঐক্যের পক্ষে অনেক বেশী অন্তরায়৷ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দল৷ বিরোধী দলনেতার মর্যাদাও মিলিয়াছে৷ কিন্তু, ত্রিপুরায় কংগ্রেস তো একেবারে শূন্যস্থানে৷ বিরোধী দলনেতার পদ হইতে অবলীলায় পদত্যাগ করিয়া যে ‘বিপ্লবাত্মক’ ঘটনার নজীর রাখিয়া সুদীপ রায় বর্মন ও অন্যান্য বিধায়করা তো ত্রিপুরার রাজনীতিতে নয়া ইতিহাসের জন্ম দিয়াছেন৷ এতোকাল কংগ্রেসের দুধ ঘি ভক্ষণ করিয়া এখন সেই কংগ্রেসকে তালাক দিবার ঘটনা রাজনীতিতে বড় বেশী প্রতিক্রিয়া অনিয়াছে সন্দেহ নাই৷ আর কংগ্রেসের ভাঙ্গা মাঠে, দলে দলে যখন দল ছাড়িবার ঘটনা ঘটিতেছে, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই দল মেরুদন্ড সোজা করিয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে না৷ আর সহসাই পরিবে বলিয়া মনেও হয় না৷
ত্রিপুরায় কংগ্রেসের এমন ভয়ংকর দুর্দিন ইতিপূর্বে আসে নাই৷ ১৯৭৭ সালে কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর পতনের পরই এ রাজ্যে কংগ্রেসের ঘর ভাঙ্গিতে থাকে৷ বিদ্রোহী কংগ্রেস বিধায়করা সিএফডি ও জনতা দলে যোগ দিয়া সিপিএমের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে৷ জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে যে শচীন্দ্রলাল সিংহ ত্রিপুরায় কংগ্রেসের প্রাণ প্রতিষ্ঠাই করেন নাই, রাজ্যে এই দলের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করিয়া ইতিহাস গড়িয়াছিলেন৷ ইন্দিরার সঙ্গে সংঘাতের কারণে শচীন্দ্রলাল বিদ্রোহী হইয়া বাবু জগজীবন রামের সিএফডি দলে যোগ দিয়াছিলেন৷ সিএফডি প্রার্থী হিসাবে পশ্চিম ত্রিপুরা লোকসভা আসনে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হইয়াছিলেন৷ শচীন্দ্র লাল যে কতখানি জনপ্রিয় নেতা ছিলেন তাঁহার দৃষ্টান্তের অভাব নাই৷ তিইি এরাজ্যে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছেন৷ আবার তিনিই এরাজ্যে ক্ষমতার মসনদে কমিউনিস্টদের অভিষিক্ত করেন৷ তাঁহার সিএফডি-সিপিএম জোট মন্ত্রিসভা সেই সাতাত্তর সালে প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল৷ যদিও সেই সরকার ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী, কয়েক মাসের৷ ত্রিপুরার ক্ষমতার সিংহাসনে সিপিএমের আরোহনের পিছনে শচীন্দ্র লাল সিংহের অবদান তো ভুলিবার নহে৷
সুতরাং আজ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-সিপিএম গলাগলির ঘটনার তেমন আশ্চর্য্য হইবার মতো নহে৷ আসলে, রাজনীতিতে নীতি বলিয়া কিছু নাই৷ ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে যে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই’র কারণে শত শত কংগ্রেসীদের প্রাণ বলি হইয়াছে, তাহার হিসাব কি আছে? অন্যদিকে কংগ্রেসের হাতে কত সিপিএম কর্মীদের প্রাণ দিতে হইয়াছে৷ এত এত রক্তের ইতিহাসের হিসাব এক নিমেষেই হাওয়া হইয়া গেল রাজনীতির ক্ষমতার স্বার্থে? সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসে মানস ভুঁইয়ার কার্য্যত বিদ্রোহ এবং ত্রিপুরায় সুদীপ বর্মনদের বিদ্রোহ সেই একই নিশানায়৷ ক্ষমতা দখলই তো এখন রাজনৈতিক দলগুলির একমাত্র লক্ষ্য৷ সেখানে নীতি আদর্শের ন্যুনতম মূল্য তো খঁুজিয়া পাওয়া মুশকিল৷ ত্রিপুরায় বীরজিৎ সিন্হা দলত্যাগীদের উচিত শিক্ষা দিতে তৎপর রহিয়াছেন৷ তিনি ধর্ণুভঙ্গ পণ করিয়াছেন পাঁচ বিধায়কের বিধানসভার সদস্য পদ বাতিল করিবেনই৷ চলিবে আইনের মারপ্যাঁচ৷ আগামী মাসে এই বিষয়ে হয়তো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হইবে৷ পাঁচ বিদ্রোহী বিধায়কের সদস্য পদ বাতিল হইলে উপনির্বাচন
অবশ্যাম্ভাবী৷ আর এই নির্বাচনে কংগ্রেস মুছিয়া যাইবার সম্ভাবনা যেমন বেশী তেমনি সবকটি বিরোধী দলের আসনই সিপিএম দলের ঝুলিতে যাইবে৷ কংগ্রেস ও বিদ্রোহী কংগ্রেসীদের কাজিয়ায় ত্রিপুরায় সিপিএমের হাতই শক্ত হইবে৷ অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে লাভ হইতেছ তৃণমূল কংগ্রেসের৷ যদি ত্রিপুরায় বিদ্রোহী পাঁচ বা ছয়জন বিধায়ক তাহাদের বিধায়কপদ টিকাইতে পারেন তাহা হইলে রাজ্যের রাজনীতি অন্যখাতে বহিবে৷ বীরজিৎবাবুরা কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়িয়া যাইবেন৷ সুতরাং বীরজিৎবাবুরা যতই সোনিয়া রাহুলের দ্বারস্থ হউন না কেন ত্রিপুরায় কংগ্রেস সহজে আর উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না৷ যেভাবে কোমর ভাঙ্গিয়াছে, সেই কোমর সোজা হইবার নয়৷ আর এজন্যই ত্রিপুরার বর্তমান রাজনীতির ঘটনা প্রবাহে ত্রিপুরায় সিপিএম দলের পক্ষে আতংকের মতো পরিস্থিতি দেখা দিবে, মনে হয় না৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *