আগামী ১৮ নভেম্বর ১২ ঘণ্টা বরাক বনধ-এর ডাক বিডিএফ-এর

অসমে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং শিলঙে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে আন্দোলন

শিলচর (অসম), ৯ নভেম্বর (হি.স.) : সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার বেকারদের প্রতি বৈষম্য এবং শিলঙে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে আগামী ১৮ নভেম্বর ভোর পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা বরাক বনধ-এর ডাক দিয়েছে বরাক ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (বিডিএফ)।
রাজ্য সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলের তালিকায় বরাক উপত্যকার প্রার্থীদের সংখ্যা খুবই কম। এছাড়া মেঘালয়ে গত ৬ দশক ধরে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন চলছে, যা প্রতিরোধে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ মেঘালয় সরকার। অবস্থা এমনই, সংখ্যালঘুভুক্ত পরিবার জীবন-জীবিকার দায়ে এতসব সহ্য করেও শিলং সহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে আসছেন। সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরাও রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা করছেন। কোনও বিকল্প না থাকায় এই দুই জ্বলন্ত ইস্যুতে এবার সমগ্র বরাক বনধ-এর ডাক দিয়েছে বরাক ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট।
আজ বুধবার শিলচরে পেনশনার্স ভবনে এই উদ্দেশ্যে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বরাক ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট-এর মুখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্তরায় বলেন, অসম সরকারের চাকরির ক্ষেত্রে যে ইচ্ছাকৃতভাবে বরাকের প্রার্থীদের প্রতি বঞ্চনা করা হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা না-হলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদের জন্য ঘোষিত তালিকায় বরাকের প্রার্থীদের সংখ্যা এতো কম হতেই পারে না। তিনি বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি, বরাকের তিন জেলা থেকে এই তালিকায় গড়ে ৩ শতাংশের বেশি মনোনীত হননি। এর পর মৌখিক পরীক্ষায় এই সংখ্যা আরও নেমে আসবে।’
প্রদীপবাবু বলেন, বিজেপির নেতা ও মন্ত্রীরা বরাকের প্রার্থীদের মনোনীত হওয়ার মতো যোগ্যতা বা মেধা নেই বলে যে যুক্তি দেখাচ্ছেন তা অসত্য ও অপমানজনক। কারণ মেধা না থাকলে রাজ্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বরাক থেকে ১২ জন মনোনীত হতেন না। বরাকের এই সব ছেলেমেয়েরাই বহিঃরাজ্যে সসম্মানে চাকরি করছেন। তাঁর প্রশ্ন, মেধা না থাকলে তা সম্ভব হতো কি?
তিনি আরও বলেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া পক্ষপাতদুষ্ট এবং দিশপুরের বরাক বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন বরাকের প্রার্থীরা। প্রদীপের প্রশ্ন, কোথায় গেল বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি? প্রকাশ্য সভায় বরাকের সব তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে স্থানীয়দের নিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন? প্রদীপবাবু বলেন, সরকার ইচ্ছে করলে তা করতে পারত, এতে কোনও আইনি বাধা নেই। যেহেতু এখানে কোনও শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেই, যাতে বরাকের ছেলেমেয়েদের নিয়োগ হতে পারে। যা ছিল তা সরকারি অবহেলায় বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এর পর যদি স্থানীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে প্রার্থী নিয়োগ করে বরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তবে বরাকের ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়?
তাই তাঁর দাবি, আগামী সাতদিনের মধ্যে বরাকের তিন জেলার শূন্য পদের তালিকা ও প্রাপ্ত নম্বর সহ এখান থেকে মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে রাজ্য সরকারকে প্রকাশ করতে হবে। তাছাড়া বরাক ভিত্তিক নিয়োগ পরীক্ষার ব্যবস্থা করে স্থানীয় পদে অন্তত ‌১০০০ প্রার্থীর নিয়োগের প্রক্রিয়া পৃথকভাবে শুরু করতে হবে। যদি তা না-করা হয় তবে আগামী ১৮ নভেম্বর শুক্রবার সকাল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত বরাক উপত্যকাব্যাপী সর্বাত্মক বনধ পালন করবে বিডিএফ।
বিডিএফ-এর মুখ্য আহ্বায়ক আরও বলেন, গ্রেফতার বা দমনপীড়ন করে বিডিএফ-এর আওয়াজ বন্ধ করা যাবে না। উপত্যকাবাসীর স্বার্থে প্রয়োজনে জেলে যেতে প্রস্তুত রয়েছেন বিডিএফ সদস্যরা। তাই সরকার উপরোক্ত দাবিগুলিকে যত শীঘ্র মেনে নেয় ততই মঙ্গল।
প্রদীপ দত্তরায় এদিন জাতিধর্ম নির্বিশেষে বরাকের আপামর জনসাধারণকে আহূত বনধ পালনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিবাদ সাব্যস্ত করার আবেদন জানিয়েছেন। পাশাপাশি বরাকের রেজিস্ট্রিকৃত তিন লক্ষ কর্মপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের তিনি নিজ নিজ এলাকায় এই বনধকে সফল করে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিডিএফ-এর মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জয়দীপ ভট্টাচার্য এদিন বলেন, সমগ্র উত্তরপূর্ব জুড়ে বাঙালি সহ সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। শিলঙে সম্প্রতি উপজাতিদের একটি মিছিল থেকে যেভাবে বাঙালি সহ নিরীহ অউপজাতিদের উপর হামলা চালানো হল এবং যেভাবে পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, তাতে এটা পরিষ্কার, এ-সবের পেছনে রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ মদত রয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্র তথা রাজ্য সরকারের উপজাতি তোষণ নীতির জন্যই গত ৬০ বছর ধরে মেঘালয়ে বিনা কারণে এভাবে দমনপীড়নের শিকার হচ্ছেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি, নেপালি, শিখ, মাড়োয়ারি ও হিন্দিভাষী অউপজাতিরা।
তিনি বলেন, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে যে সংগঠন প্রকাশ্যে লিখতে পারে ‘আমরা রক্তসূত্রে খাসি, দুর্ঘটনাবশত ভারতীয়’, তাঁদের বিরুদ্ধে কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? যদি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে আলফা কিংবা কাশ্মীরের জঙ্গি সংগঠনের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? তাই তাঁর দাবি, অবিলম্বে ‘খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ সহ মেঘালয়ের উগ্র আঞ্চলিকতাবাদী সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং আগামী সাতদিনের মধ্যে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে স্পষ্টীকরণ দিতে হবে। অন্যথা ১৮ নভেম্বর বরাক উপত্যকায় প্রতিবাদ স্বরূপ সর্বাত্মক বনধ হবে।
বিডিএফ-এর আরেক আহ্বায়ক হৃষীকেশ দে বলেন, ১৯৭৯ সালের দাঙ্গায় মেঘালয়ে ৫০ জন বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এর পর থেকে ক্রমাগত নেপালি, শিখ, মাড়োয়ারি সহ সমস্ত অউপজাতি গোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন। হত্যাও করা হয়েছে। কিন্তু এটি দুর্ভাগ্যজনক যে আজ পর্যন্ত একটি দুষ্কৃতীও যথাযথ শাস্তি পায়নি। তিনি বলেন, এবারও অন্তত ২৫/৩০ জন ওইদিনের হামলায় জড়িত থাকলেও রাজ্য সরকার চারজনের বেশি দুষ্কৃতীকে খুঁজে বের করতে পারেনি। হৃষীকেশ বলেন, আমরা জানি, কয়েকদিন হাজতে রেখে অপরাধ প্রমাণ হয়নি বলে এদের ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না-কেন, গত ৬০ বছর ধরে তা-ই হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার আমরা দেখতে চাই, মেঘালয়ে আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু আছে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে তার প্রমাণ দিতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে আগামীতে এই প্রবণতা বন্ধ হয়। অন্যথা সারা বরাক জুড়ে এবার প্রতিবাদ হবে।
বিডিএফ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির নবনিযুক্ত আরেক আহ্বায়ক আইনুল হক মজুমদার বলেন, বরাকের ছেলেমেয়েদের ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চনা করার পরও এই উপত্যকা থেকে বিজেপির নির্বাচিত বিধায়করা যেভাবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন তা সত্যিই লজ্জাজনক। তিনি বলেন, যাঁদের নির্বাচিত করা হল, ভোটারদের প্রতি তাঁদের যদি কোনও দায়বদ্ধতা না থাকে, যদি নিজের স্বার্থ চিন্তা তাঁদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে জনগণের দুর্ভোগ বাড়বেই। এ প্রসঙ্গে উপত্যকার একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে উত্তর করিমগঞ্জের বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ‌‌ের ভূয়সী প্রশংসাও করেন তিনি।
বিডিএফ-এর অন্য আহ্বায়ক খাইদেম কান্ত সিং, দেবায়ন দেবরা বলেন, শুধু বাঙালি নয়, বরাক তথা উত্তরপূর্বের সব নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় নিরন্তর কাজ করে চলেছে বিডিএফ। তাই ভাষা এবং ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিডিএফ আহূত আগামী ১৮ নভেম্বরের বনধ কর্মসূচিকে সফল করে তোলার আহ্বান জানান তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *