কলকাতা, ১৫ ডিসেম্বর (হি. স.) : কলকাতা পুরসভার নির্বাচন বয়কটের ডাক দিল কলকাতার বাড়িওয়ালাদের সংগঠন দি ক্যালকাটা হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠন মনে করে, কলকাতার পুর সমস্যা সমাধানে বর্তমান পুরবোর্ড পুরোপুরি ব্যর্থ।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুকুমার রক্ষিত বলেন, “আমরা যে দাবিগুলি সামনে রেখে আন্দোলন পরিচালনা করছি, সেগুলি পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, কেন দি ক্যালকাটা হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে।যুক্তি হিসাবে একগুচ্ছ অভিযোগ পেশ করল সংগঠন। হাওড়া ব্রিজ কর ছাড়া বাকি বিষয়গুলো হল ২) ইউনিট এরিয়া ট্যাক্সেশন বাধ্যতামূলক করা, ৩) পুর করের বিল থেকে ভাড়াটিয়াদের প্রদত্ত অংশ আলাদা করা, ৪) জরাজীর্ণ বাড়ির সংস্কার, ৫) হকার সমস্যার সমাধান, ৬) পর্দা লাইসেন্স, ৭) প্লাস্টিকের ব্যবহার, ৮) জলজমার সমস্যা, ৯) জলকর আদায়।
বুধবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে সংগঠনের এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভোট বয়কটের আবেদন করা হয় বাড়ি, ফ্ল্যাট মালিকদের। বলা হয়, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে, বামদলগুলি বা বাড়িওয়ালাদের সমস্যা মেটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিজেপি-ও তাদের ইস্তাহারে বাড়িওয়ালাদের সমস্যাগুলি সমাধান একটি শব্দও ব্যয় করেনি। বরং অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, বিজেপি কলকাতার বাড়িওয়ালাদের স্বার্থের পরিপন্থী কথাই বারবার বলে এসেছে।
হাওড়া ব্রিজ আইন ১৯২৬ মোতাবেক এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে দীর্ঘকাল। স্বাধীনতার আগে থেকে কর দিয়ে চলেছেন কলকাতা ও হাওড়ার বাসিন্দারা, যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই অজানা। ওই দুই শহরের মেলবন্ধনের প্রধান সেতু হওয়ায় ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছে কর দেওয়া। ব্রিটিশরা ওই নিয়ম করেছিল। করের টাকা আদায়ের একটা পদ্ধতিও বানানো হয়েছিল। সম্পত্তি করের সঙ্গেই তা যুক্ত করে দেওয়া হয়। সে নিয়ম চলছে আজও। হাওড়া ব্রিজের কর প্রত্যাহারের দাবি নতুন নয়। করদাতাদের উপর থেকে সেই বোঝা তুলে দেওয়ার দাবি তুলেছেন বিরোধী কাউন্সিলরেরা। ২০১৬ সালেই কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অনন্তকাল ধরে এই দুই শহরের করদাতাদের থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। নতুন ব্যবস্থা শুরুর আগে পুরনোটি বন্ধ করার এটাই উপযুক্ত সময়।’’ বিকাশবাবুর বক্তব্য, ‘‘ব্রিজ তৈরির পরে খরচ তোলার জন্য ওই টাকা তোলা হতো। এখন তো তেমন সমস্যা নেই। সরকার রক্ষণাবেক্ষণের টাকা দিতেই পারে। অন্য অনেক সেতুর ক্ষেত্রে যেমন করে থাকে। মানুষের উপরে বাড়তি বোঝা চাপানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না।’’
১) ইউনিট এরিয়া ট্যাক্সেশন : অতীতে যে পদ্ধতিতে সম্পত্তি কর ধার্য করা হতো তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে কর ধার্য করার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এই ইউনিট এরিয়া পদ্ধতিতে কর নির্ধারণ করার অর্থ, বহুগুন কর বৃদ্ধি করা। ইউনিট এরিয়া পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ভাড়ার পরিমাণ এবং অতীতের মূল্যায়নকে অগ্রাহ্য করে বাড়ি কোন রাস্তায়, কতটা জায়গা নিয়ে অবস্থিত, কোন দিকে দরজা ইত্যাদি বিষয়গুলি বিবেচনায় এনেছে। আমাদের বক্তব্য উপযুক্তভাবে সংশোধন করে এই ব্যবস্থা চালু করা হোক, যাতে বর্তমান করের উচ্চহার কমে এবং বাড়িওয়ালাদের আর্থিক দিক দিয়ে সুবিধা হয়। কারণ ইউনিট এরিয়া পদ্ধতিতে কর নির্ধারণ করলে পুরনো বাড়ির মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বাড়িওয়ালাদের সম্পত্তি করের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যাবে। বৰ্দ্ধিত কর এবং বকেয়া কর দিতে না পারলে কলকাতার অধিকাংশ বাড়িওয়ালা প্রোমোটার, ডেভলপারদের হাতে সম্পত্তি জলের দরে তুলে দিতে বাধ্য হবেন।
২) ইউনিট এরিয়া ট্যাক্সেশন বাধ্যতামূলক করা : সম্প্রতি কলকাতা পুরসভা প্রতিটি বাড়িওয়ালার ক্ষেত্রে ইউনিট এরিয়া ট্যাক্সেশন বাধ্যতামূলক করার জন্য রাজ্য সরকারকে সুপারিশ করেছে। রাজ্য সরকার কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন সংশোধন করে আইন পাশ করলে বিষয়টি সব বাড়িওয়ালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অতীতে ইউনিট এরিয়া ট্যাক্সেশন বাধ্যতামূলক ছিল না। কেবলমাত্র নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সংশোধনী আইন পাশ হয়ে গেলে প্রত্যেককেই অনেক বর্ধিত হারে পুরকর দিতে হবে।
৩) পুর করের বিল থেকে ভাড়াটিয়াদের প্রদত্ত অংশ আলাদা করা : বর্তমানে বাড়িওয়ালার পুর করের বিলেই ভাড়াটিয়াদের করের অংশ ঢোকানো থাকে। অর্থাৎ বাড়িওয়ালাদেরই ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে পুরকর, কমার্শিয়াল সারচার্জ আদায় করে তা পুরসভায় জমা দিতে হয়। যদি ভাড়াটিয়া ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়, সেক্ষেত্রেও বাড়িওয়ালাকে নিজের পকেট থেকে সেই কর ঢোকাতে হয়। আমরা চাই, ভাড়াটিয়াদের প্রদত্ত পুরকর আলাদা বিলের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে সরাসরি আদায় করে হোক।
৪) জরাজীর্ণ বাড়ির সংস্কার : সম্প্রতি রাজ্য সরকার জরাজীর্ণ বাড়ির সংস্কারের জন্য নতুন আইন আনতে চলেছে। এই আইন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালা বাড়ির সংস্কার না করলে পুরসভা সেই বাড়ি অধিগ্রহণ করে প্রোমোটারের হাতে তুলে দেবে। প্রোমোটার নতুন করে বাড়ি তৈরি করে ঠিক যেটুকু অংশে বাড়িওয়ালা বসবাস করে সেটুকুই তাদের ভোগদখলের জন্য ছেড়ে দেবে। ভাড়াটিয়াদের অংশ তারা ফেরৎ পাওয়ার পর, অতিরিক্ত নির্মাণের পুরোটাই প্রোমোটার বিক্রি করে দিতে পারবে। এই সিদ্ধান্ত আসলে সরকারি দলের অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রোমোটার ডেভলপারদের হাতে ব্যক্তি সম্পত্তির অধিকার তুলে দেওয়ার চতুর কৌশল। সাংবিধানিক দিক দিয়ে পুরসভার বাড়ি অধিগ্রহণ করার কোনও ক্ষমতাই নেই। কিন্তু রাজ্য সরকার ঘুর পথে আইন করে বেআইনি কাজকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে। জরাজীর্ণ বাড়িগুলি খালি করার জন্য কলকাতা পুরসভা বারবার হুমকি দিচ্ছে বটে, কিন্তু ঘুর পথে তারাই আবার ওইসব বাড়িতে ভাড়াটিয়াদের পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা করছে। কীভাবে? যে জরাজীর্ণ বাড়িতে পুরসভা “বিপদজজনক” নোটিশ ঝোলাচ্ছে সেখানেই আবার ব্যবসায়ীদের ট্রেডলাইসেন্স পুননবীকরণ করছে, পর্দা লাইসেন্স দিচ্ছে। কলকাতা পুলিশও বাণিজ্যিক দোকানগুলিকে ফুড লাইসেন্স ইস্যু করছে। দেওয়া হচ্ছে দমকলের লাইসেন্সও । বহাল থাকছে জলের লাইন, নিকাশি লাইন ও বিদ্যুতের মিটার। বিপদজজনক বাড়িতে থাকা ও ব্যবসা চালানোর সাড়ম্বর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে পুরসভা স্বয়ং।
৫) হকার সমস্যার সমাধান : আমরা অতীতেও বলেছি, আবারও বলছি, হকার সমস্যার জন্য পুরোপুরি দায়ী রাজ্য সরকার। হকারদের জন্য কলকাতার বহু স্বল্পপরিসর রাস্তা ক্রমশ অবরুদ্ধ হচ্ছে। অথচ জীবিকায় হাত পরবে বলে সরকার নীরব। আমরা মনে করি, ভাড়ার হারের পুনর্বিন্যাশ ঘটানোর অধিকার যদি বাড়িওয়ালারা পেতেন এবং কনট্রোল প্রথা পুরোপুরি তুলে দিতেন বাজার সংস্কারের জন্য ঋণ লাভ সহজ হতো, তাহলে বাজারগুলির এমন জরাজীর্ণ দশা হতো না। বহু নতুন বাজার তৈরি হতো, সেই সঙ্গে পুরনো বাজারের সংস্কারও সম্ভব হতো। প্রতিযোগিতামূলক হারে ভাড়ার ব্যবস্থা হলে, রাস্তার হকাররা পাড়ার মস্তান, ইউনিয়ন, পুলিশকে একগাদা টাকা দেওয়ার পরিবর্তে আইনসঙ্গত উপায়ে পাকা বাজার স্টল নিতে সক্ষম হতেন।
৬) পর্দা লাইসেন্স : দোকানের সাইনবোর্ড টাঙানোর জন্য পুরসভা লাইসেন্স প্রদান করত। কিন্তু এখন বিনা লাইসেন্সে বহু দোকান, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে। পুরসভা দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দোকানে বিক্রি হওয়া খাবার রাস্তায় রান্না করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিধি লংঘনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, কনজারভেন্স ট্যাক্সও আদায় করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পথ চলা দায় হচ্ছে।
৭) প্লাস্টিকের ব্যবহার : অতীতে প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার অঙ্গীকার অনেকেই করেছিল, কিন্তু মুখের কথাই সার। প্লাস্টিকের ব্যবহার আরও বেড়েছে, যে কারণে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা ক্রমশ ভেঙে পড়ছে।
৮) জল জমার সমস্যা : বেহালা, টালিগঞ্জ, যাদবপুর, শরৎ বসু রোড, সাদার্ন অ্যাভেনিউ, রামমোহন সরণী, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ, বিধানসরণী, উল্টোডাঙ্গা প্রভৃতি এলাকার বহু রাস্তায় বৃষ্টি হলে জল নামতেই চায় না। শত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও জমা জল বের করার জন্য উপযুক্ত নিকাশী ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি। এ জন্য বাড়ির ভিত আলগা হয়ে ভেঙ্গে পরার অন্যতম কারণ।
৯) হাওড়া ব্রিজ কর আদায় : শহর কলকাতার রাস্তা গোটা দেশের মানুষ ব্যবহার করলেও হাওড়া ব্রিজের জন্য কর দিতে হয় শুধুমাত্র কলকাতার বাড়িওয়ালাদের। কেন এই বিষম্য এই কোনও উত্তর নেই।
১০) জলকর আদায় : আমাদের আশঙ্কা বিশ্বব্যাঙ্ক ও এশিয়া ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী, কলকাতার পানীয় জলের ওপর মোটা অঙ্কের কর বসতে চলেছে গৃহস্থের বাড়ির কলের সঙ্গে মিটার জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা স্থির নিশ্চিত, এর ফলে প্রত্যেককে মোটা টাকা অতিরিক্ত কর দিয়ে হবে। টালা ব্রিজ পুননির্মাণসহ একাধিক কারণে এমনিতেই পরিশ্রুত পানীয় জলের সরবরাহ অনেকটাই কমে গিয়েছে। তার ওপর অতিরিক্ত জল কর আদায়ের এই প্রক্রিয়া অনেকটা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতোই প্রতিপন্ন হচ্ছে। এখন সমস্ত করের সঙ্গে জল কর নেওয়া হয় আবার আলাদা করে জল কর নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
উপরোক্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করে কলকাতার বাড়িওয়ালারা এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে যে, অসন্তোষ ও দাবি তুলে ধরার জন্য ভোট বয়কট উপযুক্ত কার্যকরী মাধ্যম। জন সাধারণের কাছে আমরা বলতে চাই, নাগরিক সমস্যা সমাধানে যারা অপারক, তাদের ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিকিয়ে দেওয়া অনৈতিক । তাই আসুন আমরা ভোট বয়কট করে প্রতিবাদকে আরও সোচ্চার বয়কট করে।