অশোক সেনগুপ্ত
একটা কবিতা কতটা জনপ্রিয় হতে পারে? জানিনা, বাংলা কবিতার জনপ্রিয়তা নিয়ে কখনও কোনও সমীক্ষা হয়েছে কিনা, তবে তা হলে ‘বিদ্রোহী‘-কে টেক্কা দিতে পারে, এমন কবিতা ক’টা আছে?
একটা সংখ্যার হিসেব দিই। বিদ্রোহী কাজী নজরুলের লেখা ‘বিদ্রোহী’ এতটাই বিখ্যাত হয়েছিল যে কাজী সব্যসাচীর কন্ঠে সেটির রেকর্ড বিপুল বিক্রি হয়। ইউটিউবে দেখছিলাম, তাঁর ওই আবৃত্তি ৩ লক্ষ ৯১ হাজার ৫৭০ বার পঠিত হয়েছে। পায়ে পায়ে কবিতাটির বয়স হল ১০০।
নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি এই ‘বিদ্রোহী’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি “চির উন্নত শির” বিরাজমান।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় তৃতীয় স্থানে আসেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।
তিনি জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারের দুখু মিয়া হয়ে। আর মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। মাঝে ৭৭ বছর জুড়ে ছিল সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার এক বিশাল ইতিহাস। এই বিপুল কীর্তির মধ্যে এক জ্যোতিষ্ক হল ‘বিদ্রোহী‘।
১০০ বছর আগে নজরুল কবিতাটি লেখেন কলকাতায় তালতলা লেনের এক বাড়িতে বসে। সেই বাড়ির প্রবেশপথের পাশে ফলকে লেখা আছে, “চিরযৌবনের প্রতীক কবি নজরুল ইসলাম তাঁর ডঙ্গম জীবনের কিছুকাল (১৯২১-২২) অতিবাহিত করেন এই প্রাঙ্গণের ভিতর ৩/৪ সি তালতলা লেনে। এখানেই রচিত হয় তাঁর বাঁধনহারা কবিমনের প্রথম উদ্দাম উচ্ছাস ‘বিদ্রোহী‘ কবিতা। তালতলা নজরুল জন্ম শতবর্ষ কমিটি। ২৪ শে এপ্রিল, ১৯৯৯। “
”সেই যুগে একটা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল- যেটা হল দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজ বিপ্লবকে মেলানো। স্বদেশী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। কিন্তু এই বিপ্লব ছিল নজরুলের রক্তে,” বলেছেন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়। তাঁর মূল্যায়নে যারা সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা – বিদ্রোহী। “সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়ার চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল এই রচনায়। সেই কবিতা রাতারাতি তাঁকে একেবারে কেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছিল। তার পরবর্তী আট দশ বছর ধরে তিনি যে সাম্যের গান গাইলেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেন, কৃষক মজুরের দুঃখের কথা বললেন, কৃষক শ্রমিক পার্টির হয়ে কাজ করলেন- এ সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে তাঁর যে মন প্রকাশ পেল তা ছিল একেবারে আলাদা। এর মধ্যে কোন আভিজাত্য নেই। একেবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান। তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল।”
নজরুল যখন কবিতাটি লেখেন, তিনি কী করতেন সেই সময়কালে? এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শেখেন। সহ-সৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে।
করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই সময়েই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়।
বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
‘বিদ্রোহী’-র শতবর্ষের স্মরণীয় দিনটিকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারি অ্যাভিনিউ ও ধর্মদাস রো-র সংযোগস্থলে কালীঘাট রোডে ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে অভিনব অনুষ্ঠান ‘বিদ্রোহী একশো’। স্মরন সন্ধ্যার মূল উদ্যোক্তা ‘এ্যনন ক্লাব’। বক্তাদের মধ্যে থাকছেন অধ্যাপক সুনীল দাস, সাংবাদিক লেখক পল্লব মিত্র, সাংবাদিক দেবাশীষ ভট্টাচার্য, কবিতা পাঠে ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য, নাচে মল্লিকা ব্যানার্জী, ‘প্রাযক’ নাট্য গোষ্ঠীর নাটক ‘অগ্নিবীনা’, লেখক চঞ্চল ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সমন্বয়ে অনেকের সঙ্গে ছিলেন অমিত ঘোষ।
এই উপলক্ষে কাশীনাথবাবু বাড়ির কাছে আয়োজন করবেন এক প্রদর্শনীর। প্রায় এক দশক ধরে খোলা ফুটপাথের ধারে ৫৬ জন মণীষীকে প্রতিটি জন্মদিনে তাঁদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্মরণ করেন। ওটাই ওঁর ধ্যানজ্ঞান। বছরভর চলে খেয়ালী কাশীনাথবাবুর এই তর্পন।
নিষ্ঠাভরে প্রায় ১০ বছর ধরে এভাবেই নবীন প্রজন্মকে কাশীবাবু চিনিয়ে যাচ্ছেন এ দেশের মহাপুরুষদের। বড়দের মনে করিয়ে দিচ্ছেন মণীষীদের কথা। এ যেন ওঁর একটা পবিত্র কর্তব্য। ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারি আর ১৫ আগস্ট পতাকা উত্তোলন করেন। বছর ৫৫-র কাশীবাবু একটি বেসরকারী সংস্থার গাড়ির চালক। এদিনের আয়োজনটি মূলত তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।



