গুয়াহাটি, ২০ ডিসেম্বর (হি.স.) : জাতির সঙ্গে কখনও প্রতারণা করতে পারেন না। কেননা, তিনিও এই সমাজের, অসমিয়া। স্বজাতির সঙ্গে প্রতারণা করা মানে পাপের বোঝা বহন, তাই জাতির বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবনায় আনতে পারেন না। বরং জাতি তথা অসমিয়াদের সুরক্ষিত রাখতে, জাতি-মাটি-ভিটের অধিকার রক্ষায় তাঁর সরকার বদ্ধপরিকর। বক্তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল। শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টায় ব্ৰহ্মপুত্ৰ রাজ্য অতিথিশালায় আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে চলমান গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থানের তথ্য দিচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর আইনি ও প্রেস উপদেষ্টা যথাক্রমে শান্তনু ভরালি এবং হৃষিকেশ গোস্বামীকে দু পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে বিশ্বাস করুন। জাতির সঙ্গে কখনও আমি প্রতারণা করছি না। আমি আপনাদেরই একজন। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি সর্বদা আপনাদের সঙ্গে আছি এবং ভবিষ্যতে থাকব।’ সর্বানন্দ বলেন, ‘অসমিয়া ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি সব কিছুই নিরাপদ থাকবে। আমাকে আপানাদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেবেন না। এই অসম চিরকাল অসমিয়াদেরই থাকবে। অশুভ চক্রের হাতে যাতে অসম চলে না যায়, সে-জন্য এই সরকার অসমিয়াদের সুরক্ষিত রাখতে কাজ করে যাচ্ছে এবং আগামীতেও করবে। কেননা, জনতার কল্যাণে কাজ করতে প্ৰতিশ্ৰুতিবদ্ধ আমরা। অন্যের জন্য কাজ করব না, তা নিশ্চিত। গত তিন বছরে এখন পর্যন্ত আমার সরকার যতটা পদক্ষেপ নিয়েছে, সে-সকল অসমের খিলঞ্জিয়া ভূমিপুত্ৰদের উন্নয়নের জন্যই।’ এরই খেই ধরে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সর্বস্তরের জনতাকে সরকারের কাজকর্মের প্রতি নিঃসন্দেহে স্বাগত জানাতে এবং প্রেরণা যোগাতে আহ্বান জানান। বলেন, ‘আসুন আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে অসমকে ভারতবৰ্ষের বুকে সবচেয়ে মজবুত রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি।’
রাজ্যের জনসাধারণের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ‘আমি আগেও আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব। জনতার স্বাৰ্থে যদি কাজই করতে না পারি, তা-হলে কীসের জন্য, কার জন্য মুখ্যমন্ত্ৰী হয়েছি? খিলঞ্জিয়া ভূমিপুত্ৰদের জন্যই মুখ্যমন্ত্ৰী হয়েছি, এবং মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব আপনারাই আমাকে দিয়েছেন।’ মুখ্যমন্ত্ৰী সনোয়াল বলেন, ‘অসমিয়া সমাজ যতটুকু স্নেহ, মমতা, আশীৰ্বাদ আমাকে দিয়েছে, তা আমি কখনও ভুলব না। আপনারাই স্নেহ-মমতা দিয়ে আমাকে শৈশব থেকে লালন-পালন করে আজকের সর্বানন্দ বানিয়ে মুখ্যমন্ত্ৰীর আসনে বসিয়েছেন। সে-কথা আমি মৰ্মে মৰ্মে উপলব্ধি করি, তা ভুলতে পারি না। এ-কথা ভুলে গেলে পাপ আমাকে ছাড়বে না। সময় কখনও আমাকে ক্ষমা করবে না। এ-সব সাধারণ কথা নয়।’
প্রাসঙ্গিক বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্ৰী দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, অসমিয়াই অসমের রাজ্যভাষা। তা কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বলেন, ‘আজ আমরা সকলে একটি কথা উপলব্ধি করছি, অসমের জনসাধারণ চান অসমে অসমিয়া ভাষা রাজ্যভাষা হিসেবে প্রচলিত হোক। সে অনুযায়ী অসমিয়া ভাষাই রাজ্যভাষা হিসেবে সদা থাকবে।’
এর পরই সিএএ প্রসঙ্গে চলমান ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ সম্পর্কে মুখ খুলেন মুখ্যমন্ত্ৰী সনোয়াল। ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘যে সকল মানুষ ফুলের মতো ছাত্ৰদের ভুল তথ্য দিয়ে, উস্কানি দিয়ে হিংসাত্মক কাৰ্যকলাপে জড়িত করিয়েছে তারা ঘোর অপরাধী। এরা কখনও অসমের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। গণতান্ত্রিক আন্দোলন আমি সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করি। কিন্তু আন্দোলনের নামে এরা যা করছে তা মোটও সমর্থনযোগ্য নয়। এরা চায় অসম ধ্বংস হয়ে যাক। অসম উন্নয়নের শিখরে উঠুক তা চায় না এরা। এরা অশুভ শক্তি, অসম তথা শান্তিপ্রিয় রাজ্যের শত্রু। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সকলকে অহিংস এবং গণতান্ত্ৰিক আন্দোলন করতে আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, আসু (সারা অসম ছাত্র সংস্থা), অসম জাতীয়তাবাদী যুব-ছাত্র পরিষদ, অসম সাহিত্য সভা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীসমাজ যে অহিংস আন্দোলন করছে তার প্রতি বিশ্বাস আছে। গণতন্ত্ৰে সকলের অহিংস আন্দোলন করার আধিকার আছে, বলেন মুখ্যমন্ত্রী সনোয়াল।
অপপ্ৰচার করে একাংশ মানুষ সাধারণ জনতার মনে ভয়ভীতি ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সনোয়াল। তিনি বলেন, একটি দুষ্টচক্ৰ আন্দোলনের নামে বিভীষিকার সৃষ্টি করে ভুল বাৰ্তা ছড়ানোর অপচেষ্টা করছে। ‘সিএএ’ বলবৎ হলে অতি নগণ্য মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন বলে জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এক ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে কেউ কেউ বলছেন, কোটি কোটি মানুষ নাকি বাংলাদেশ থেকে আসবেন এবং তাদের রাজ্যবাসীর ভূমি এবং চা বাগানের সিলিং ল্যান্ডে বসবাসের সুবিধা দেওয়া হবে। এ সব অকাট্য ভুল তথ্য, কেবলমাত্র বিভ্ৰান্তি ছড়াতেই এ ধরনের ভয়ানক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। নতুন করে কেউ আসবে না, ভারত তথা অসমে যে নগণ্য-সংখ্যক আছেন আবেদনের ভিত্তিতে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে, স্পষ্টীকরণ দিয়ে জানান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ। বলেন, ‘আমি যতদিন পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্ৰী থাকব ততদিন কোনওভাবেই অসমের স্বাভিমান ধ্বংস হতে দেব না।’ বলেন, ধৰ্মীয় উৎপীড়ণের বল হয়ে আমাদের সঙ্গে বসবাসরত অতি কমসংখ্যক মানুষ সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া একজনও নতুন বাংলাদেশি আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। কতজন নাগরিকত্ব পাবেন তা পরবর্তীতে সর্বসমক্ষে আনা হবে।’ জনান মুখ্যমন্ত্ৰী সনোয়াল।
এছাড়া সিএএ-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দল-সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের বোঝানো হবে। এর দ্বারা উদ্ভূত সমস্যার সমাধান তিনি করতে পারবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি জানান, অতি নিষ্ঠার সঙ্গে অসম চুক্তির ৬ নম্বর দফা কাৰ্যকর করে অসমের জনসাধারণকে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দিতে বলেছেন প্ৰধানমন্ত্ৰী নরেন্দ্ৰ মোদী। এরই ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্ৰী অমিত শাহ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ দেওয়ার জন্য লোকসভা ও রাজ্যসভায় ঘোষণা করেছেন। বলেন, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর থেকে অহোরাত্র অসমের স্বাভিমান রক্ষায় নিয়োজিত নরেন্দ্র মোদী। অসমের স্বাভিমান গামোছা গলায় ধারণ করে চলাচল করেন, সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজরিকাকে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করেছেন এই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সরকারি কাৰ্যালয়, ব্যাংক, গণ-সম্পত্তি ধ্বংস করা, বিধায়কের ঘরে আক্ৰমণ করে অগ্নিসংযোগ করা, কেন্দ্ৰীয় মন্ত্ৰী রামেশ্বর তেলির ঘরে হামলা প্ৰসঙ্গে প্ৰতিক্ৰিয়া ব্যক্ত করে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, এই সব কাৰ্যে ভুল তথ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে সহজ-সরল কৃষিজীবী ও সাধারণ জনতাকে বিপথে পরিচালিত করে নিয়োজিত করছে কতিপয় মানুষ, এদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বলেন, এ-ধরনের মানুষকে প্ৰশ্রয় দেওয়া উচত নয়। এদের প্ৰশ্রয় দিলে অসমের কোনওভাবে উন্নতি হবে না। মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘যারা মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রচার করে জনসাধারণকে বিভ্ৰান্ত করে অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে তাদের মুখোশ খোলা হবে। ইতিমধ্যে বহু অশুভ শক্তির সদস্যকে গ্ৰেফতার করা হয়েছে, আরও হবে। তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা হবে।’
চা শ্ৰমিকদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, চা শ্ৰমিকদের অধিকার সৰ্বকালের জন্য সুরক্ষিত থাকবে। শান্তিপ্রিয় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের মধ্যে অসমে উজ্জ্বল করার ডাক দিয়েছেন সর্বানন্দ সনোয়াল। অসম চুক্তির ৬ নম্বর দফা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ১৪ জনকে নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি বহু আগে গঠন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে কাজ করছে কমিটি। কমিটির প্ৰতিবেদন পাওয়ার পরই এই দফা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এছাড়া সিএএ-কে কেন্দ্র করে ভারতীয় মুসলমানদের কোনও চিন্তা না করতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘অপপ্ৰচারে আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না। আপানাদের ভুল বার্তা দিয়ে অসমে অশান্তি কায়েম করতে চাইছে অশুভ শক্তি।’ আন্দোলনে নিহতদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সহায়তা প্রদান সম্পর্কিত এক জিজ্ঞাসার জবাব দিতে গিয়ে প্রথমে তাঁদের জন্য দুঃখ ও সমবেদনা প্ৰকাশ করে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ঘটনার তদন্ত করতে এসআইসি গঠন করা হয়েছে। এসআইটি-র প্ৰতিবেদন দাখিলের পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।