কলকাতা, ১ ডিসেম্বর ( হি.স.) : শুক্রবার লজ্জায় মুখ ঢাকল শহর কলকাতা ! কলকাতার নামি জি ডি বিড়লা স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক বিভাগের ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে স্কুলেরই শারীরশিক্ষার শিক্ষক অভিষেক রায়ের বিরুদ্ধে । রাতেই নির্যাতিতা শিশুকে নিয়ে নেতাজি নগর থানায় যায় পরিবার । সেখান থেকে যায় যাদবপুর থানায়।
অভিযোগ, বারবার আবেদন সত্ত্বেও প্রথমে অভিযোগ নিতে চায়নি পুলিশ । ভুল পথে চালনা করা হয়েছে অভিভাবকদের । পরে, এই ঘটনায় যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে ওই ছাত্রীর পরিবার । অভিযুক্ত শিক্ষককে গেফতার করেছে পুলিশ । এখন এস এস কে এম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ছাত্রী । হাসপাতালে পুলিশ শিক্ষকদের ছবি দেখালে আরও এক জনকে সনাক্ত করেছে ছাত্রীটি । তাকে এখন খুঁজছে পুলিশ ।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার স্কুল থেকে ফেরার পর পোশাক পরিবর্তনের সময় শিশুর গোপনাঙ্গে ক্ষত প্রথম নজরে আসে মায়ের। শিশুর গোপনাঙ্গ থেকে অনর্গল রক্তক্ষরণ হচ্ছিল বলে দাবি নির্যাতিতা শিশুর মায়ের । জিজ্ঞাসা করতে কান্নাকাটি শুরু করে সে । স্কুলেরই পি টি টিচার যৌন হেনস্থা করেছে বলে জানায় । হতভম্ব মা তৎক্ষণাত্ ফোন করেন শিশুর বাবাকে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পারিবারিক ডাক্তারের কাছে । শিশুকে দেখে তিনি বলেন, যৌন হেনস্থা করা হয়েছে । পুলিশের কাছে যেতে বলেন । এরপর শিশুকে নিয়ে নেতাজি নগর থানায় অভিযোগ জানাতে যায় তার পরিবার । কিন্তু, ওই স্কুল তাদের এলাকার মধ্যে পড়ে না বলে যাদবপুর থানায় পাঠানো হয় । পরে সেখান থেকে যাদবপুর থানায় যায় নির্যাতিতা শিশুর পরিবার ।
পুলিশের তৎপরতায় রাতেই নির্যাতিতা শিশুকে নিয়ে যাওয়া হয় এস এস কে এম হাসপাতালে । কোনও পুলিশি নির্দেশিকা ছাড়াই শিশুটিকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য এস এস কে এম হাসপাতালে পাঠানো হয় ।
পুলিশের নির্দেশিকা না থাকায় শিশুটির মেডিক্যাল পরীক্ষা করতে রাজি হননি চিকিৎসকরা । গাফিলতির সেই অভিযোগ অবশ্য খারিজ করে দিয়েছেন এস এস কে এম-এর অধিকর্তা । জি ডি বিড়লা স্কুলের নির্যাতিত শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষায় কোনওরকম দেরি হয়নি । কোনও গাফিলতি হয়নি চিকিত্সাতেও, সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দাবি করলেন এস এস কে এম-এর অধিকর্তা অজয় রায় । একইসঙ্গে তিনি জানান, নির্যাতিতা শিশুর শারীরিক অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল । নিয়ম মেনেই চিকিত্সা চলছে শিশুটির । এধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে আইনি দিকগুলিও মেনে চলা হচ্ছে ।
অজয় রায় জানিয়েছেন, বর্তমানে শিশুটিকে চিকিত্সা করছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা । তবে এখনই শিশুটির কাউন্সেলিংয়ের জন্য কোনও মনোবিদকে নিয়োগ করা হচ্ছে না । এক্ষুণি কোনও মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হচ্ছে না বলেও জানান তিনি । অজয় রায় বলেন, বেশকিছু পরীক্ষা হয়েছে । আরও পরীক্ষা চলছে । খতিয়ে দেখা হচ্ছে যৌন হেনস্থার অভিযোগ । ডাক্তারি পরীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পর হাতে আসবে । রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত শিশুকে যৌন হেনস্থা করা হয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি এস্এসকেএম ডিরেক্টর ।
এদিকে, শুক্রবার সকাল থেকেই যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে ধুন্ধুমার জিডি বিড়লা স্কুলে । স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ অভিভাবকদের । অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এদিন সকালে অভিযুক্তকে আটক করে ।পরে গ্রেফতার করে। পুলিশ সূত্রে খবর অভিযুক্তের বাড়ি বীরভূম জেলার বোলপুরে । কলকাতার গড়িয়া অঞ্চলে গত ৬ বছর ধরে ভাড়া থাকতেন তিনি ।
ইতিমধ্যেই শহরের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় তদন্তে নেমেছে যাদবপুর থানার পুলিশ । অভিযুক্তের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন অভিভাবকরা । এমন অবস্থায় হস্তক্ষেপ করেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় । বেসরকারি স্কুল হওয়া সত্ত্বেও নিজে থেকে ডেকে স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী । জিডি বিড়লা স্কুলের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কড়া শাস্তি দিতে হবে’। তিনি আরও বলেন, ‘বোর্ডর মাধ্যমে ডেকে পাঠাবো। তারপর যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেব’। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী । তিনি বলেন, ‘রাজ্য সরকার এই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে । প্রাথমিক শিক্ষা সংসদকে এই বিষয়কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি । ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী আরও জানান, যেখানে বেশি টাকা নিয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের ভর্তি করা হচ্ছে সেখানে নিরাপত্তার এই গাফিলতি কোনওভাবেই মানা হবে না । গাফিলতি প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ।
জি ডি বিড়লা স্কুলে এই ঘটনা এই প্রথমবার ঘটল, তেমনটা একেবারেই নয় । তিন বছর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল শহরেরে এই অভিজাত স্কুলে । অনেকেই অভিযোগ করছেন, এত টাকা অনুদান দিয়ে স্কুলে ভর্তি করানোর পরও পড়ুয়াদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ । এই প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘এখনও যদি স্কুলের ঘুম না ভাঙে তা পরিতাপের বিষয়’। শহরে অভিজাত স্কুলে নার্সারির ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন রাজ্যের নারী এবং শিশু কল্যাণ মন্ত্রীও । ‘এক কথায় নিন্দনীয়। ধিক্কার জানানোর মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না’, প্রতিক্রিয়া শশী পাঁজার ।
রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘নিয়োগের আগে স্কুল কর্তৃপক্ষের উচিত শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করানো’। নির্যাতিতা শিশুর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থানের দিকটিও চিন্তায় ফেলেছে তাঁকে । তিনি বলেন, ‘যে ট্রমা দেওয়া হল তা থেকে শিশুটি কখনই বেরোতে পারবে না। সারা জীবনের ক্ষতি হয়ে গেল’। একই সঙ্গে ‘দোষীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’র দাবিও জানিয়েছেন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। রানিকুঠির স্কুলে শিশুকে নির্যাতন‘আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা করা উচিত । স্কুল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না, একই ঘটনা আগেও ঘটেছে বলে শুনেছি’।
অন্যদিকে, স্কুল উত্তাল হয়েছে পড়ুয়াদের নিরাপত্তার দাবিতে । অভিভাবকদের বিক্ষোভের মুখে অবশেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জিডি বিড়লা স্কুলের প্রিন্সিপাল শর্মিলা নাগ জানালেন, নিরপত্তায় বাড়তি নজর দেবে স্কুল ‘।সাংবাদিকদের তিনি জানান, ‘ছাত্রীরা আমার মেয়ের মতো । আমি তো চাই না এমন ঘটনা ঘটুক। অভিভাবকরা নিরপত্তাকে সবথেকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, আমরাও সেটাই করব। ডিসেম্বরেই স্কুলে বসবে সিসিটিভি’। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীন তদন্তের জন্য অভিভাবকদের কাছে সময়ও চেয়ে নেন শর্মিলা নাগ । কী ব্যবস্থা নেবেন অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ? জবাবে প্রিন্সিপাল জানান, ‘পুলিশি তদন্ত চলছে, রিপোর্ট আসুক, আমি তখনই বলব । আমাদের একটু সময় দিন’। স্কুল কি তাহলে বন্ধ থাকবে ? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধান শিক্ষিকার উত্তর, ‘অভিভাবকদের কেউ বলছেন বাচ্চাদের পাঠাবেন না। কেউ বলছেন পাঠাবেন। আমি কী করব বলুন’ ?
যদিও এদিন শারীরশিক্ষা শিক্ষক অভিষেক রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানতে চাননি শর্মিলা নাগ। অভিযুক্ত শিক্ষকের হয়ে সাফাই গেয়ে প্রিন্সিপাল বলেন, ‘ফিজিক্যাল ট্রেনার অভিষেক রায় ৬-৭ বছর ধরে স্কুলে রয়েছেন । এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে এমন কোনও অভিযোগ আসেনি’। স্কুলেরই আরেক শিক্ষিকাকে ক্যামেরার সামনেই বলতে শোনা যায়, ‘যদি কেউ দুষ্টুমি করে, তাকে কি আটকানো যায় ‘?
স্কুলের উত্তরে আদৌ খুশি নয় শিশু সুরক্ষা কমিশন । শিশু সুরক্ষা বিধি কতটা মানা হয়েছে ? তা জানতে চেয়ে স্কুলকে চিঠি পাঠিয়েছে শিশু সুরক্ষা কমিশন । ইতিমধ্যেই শিশুসুরক্ষা বিধি নিয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে স্কুল শিক্ষা দফতর । বেসরকারি স্কুলকেও তা মানতে হবে বলে দফতর । তার বেশিরভাই মানেনি জি ডি বিড়লা স্কুল । আগামী সপ্তাহেই শাস্তি ঘোষনা করা হবে বলে স্কুল শিক্ষা দফতর জানা গেছে । শিশুসুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রিন্সিপ্যালের ব্যবহার ভাল নয় । স্কুলের উত্তর সন্তোষজনক নয় ।স্কুলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে’ ।
লোন করে ডোনেশন দিয়ে নামী স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন বাড়ির মেয়েকে । কিন্তু স্কুলেই যে এমন পরিণতি ঘটবে, কল্পনা করতে পারছেন না নির্যাতিতা শিশুর দাদু । এস এস কে এম হাসপাতালে নাতনির ডাক্তারি পরীক্ষা হবে, তারপরই জানা যাবে ঠিক কী ঘটেছে নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে । এস এস কে এম হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন দাদু । বললেন, নাতনি বেঁচে আছে, ভগবানের অপার আশীর্বাদ, আইনে বিশ্বাস করি । এমন ঘটনায় যা শাস্তি হওয়া উচিত সেটাই আশা করছি’।
নির্যাতিতার শিশুর দাদু জানান, ‘ও (নাতনি) বেঁচে আছে, এটাই সবথেক বড় । আর কখনও ওই স্কুলে (জিডি বিড়লা) যাবে না ‘। ভারাক্রান্ত এবং চিন্তিত তিনি আরও বলেন, ‘এত নামী স্কুল কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত। আর কারোর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটুক, কখনওই চাই না’।
খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচার হতেই, ক্ষোভে ফেটে পড়েন বাকি অভিভাবকরা । স্কুলে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা । বেশিরভাগই দাবি করছেন, এত টাকা ডোনেশন নিয়ে ভর্তি করানো হয়, অথচ বাচ্চাদের এতটুকুও নিরাপত্তা নেই! যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ বারেবারেই বিক্ষোভকারী অভিভাবকদের থেকে তদন্তের স্বার্থে সময় চাইছেন । নারকীয় নির্যাতনের শিকার হওয়া ৪ বছর বয়সী ছাত্রীর বাবার অভিযোগ, ‘যে ধরনের ক্ষত তৈরি হয়েছে তা স্বাভাবিকভাবে হয় না । শারীরিক নির্যাতনের কারণেই এমন ক্ষত হয়েছে’।
2017-12-01