নিজস্ব প্রতিনিধি, আগরতলা, ১০ অক্টোবর৷৷ রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা অক্ষুন্ন রাখার উপর গুরত্বারোপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ পাশাপাশি তিনি আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার জন্যও সতর্ক করেছেন৷ মানিক সরকার দাবি করেন রাজ্যের
একাংশ উপজাতি অংশের যুবকদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে৷ আর এই কাজ করছে বিজেপি এবং আইপিএফটি৷ তিনি বিভ্রান্ত যুবকদের আলোচনার মাধ্যমে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার উপর জোর দিয়েছেন৷ সেই সাথে কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন নীতিরও তিনি সমালোচনা করেছেন৷ মঙ্গলবার দুপুরে বিশালগড়ের গোলাঘাটি মোটরস্ট্যান্ডে সিপিএম দলের এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি একথা বলেন৷ এই সমাবেশে দলের অন্যান্য নেতৃত্বরা রাজ্যে বিজেপি এবং আইপিএফটির বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন৷
এদিকে, গালাঘাটি কৃষক আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে শহীদ স্মৃতি সৌধ, শহীদ স্মৃতি উদ্যান ও খুমচাক কলাকেন্দ্রের আজ উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার৷ আজ দুপুরে প্রথমেই উদ্বোধন করেন ভক্তঠাকুর গাট সংলগ্ণ শহীদ স্মৃতি সৌধের৷ খুমচাক কলাকেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে
মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেন, আজ ত্রিপুরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন৷ তৎকালীন সময়ের মহাজনী শোষণের এক নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হল এই ভক্তঠাকুর পাড়া এলাকা৷ ৬৯ বছর আগে যারা মহজনী শোষণের বলি হয়েছিলেন তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে সরকারী উদ্যোগে শহীদ স্মৃতি উদ্যান, স্মৃতি সৌধ ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়েছে৷ এগুলি করার জন্য সরকারী জায়গা ছিল কম৷ বেশ কয়েকজন তাদের নিজেদের জোত জায়গার কিছু অংশ ছেড়ে দেয়ায় এই পার্ক, স্মৃতি সৌধ ইত্যাদি গড়ে ওঠেছে৷
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, যারা অত্যাচারী শোষক তারা স্বল্প সময়ের জন্য সুখ ভোগ করার সুযোগ পান৷ ইতিহাস তাদের ক্ষমা করেনা৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সেদিন যে শোষণ, অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই করেছিলেন এর রেশ এখনও শেষ হয়ে যায়নি৷ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন কায়দায় শোষণের মাত্রা অব্যাহত রয়েছে৷ জাতীয় নীতির পরিবর্তন না হলে এই শোষণের মাত্রাও হ্রাস পাবেনা৷ এই শোষণের বিরুদ্ধে সারা দেশে যে লড়াই সংগ্রাম শুরু হয়েছে তাতে ত্রিপুরার মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন৷
তিনি বলেন, রাজ্যের একটি অংশের মানুষকে বিপথগামী করার জন্য অনবরত প্রয়াস জারী রয়েছে৷ গোলাঘাটির ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের কাছে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে হবে৷ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার অর্থ ব্যায় করে এই পার্ক, স্মৃতি সৌধ ইত্যাদি গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু এলাকার জনগণকেই এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে৷ খুমচাক কলাকেন্দ্রের দ্বারোদঘাটন করে ত্রিপুরা উপজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদের মুখ্য কার্যনির্র্বহী সদস্য রাধাচরণ দেববর্র্ম রাজ্যে শান্তি বিনষ্টের চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত প্রতিরোধ করে জাতি উপজাতির শান্তি অক্ষুন্ন রাখতে সকল অংশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানান৷ শুরুতেই তিনি ১৯৪৮ সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন৷ তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৮৪ সালের আজকের দিনে যারা শহীদ হয়েছিলেন ত্রিপুরার মানুষ চিরদিন তাদের স্মরণে রাখবেন৷ তিনি বলেন, এখনো শোষণ শেষ হয়ে যায়নি৷ শোষকের কোন জাত নেই৷ তারা সবাইকে শোষণ করে৷ রাজ্যে জাতি উপজাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যে চক্রান্ত চলছে জাতি উপজাতি সকল অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ভাবেই তা প্রতিহত করতে হবে৷
সম্মানিত অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক নিরঞ্জন দেববর্র্ম৷ সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি ১৯৮৪ সালের গোলাঘাটির কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে বলেন, সেদিন মহাজনের নিজক ধান চাইতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে অনেকগুলি প্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল৷ তাঁদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজ্যের জাতি উপজাতি সকল অংশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে শহীদদের এই দিনে স্মরণ করে আসছেন৷ এখানে জাতি উপজাতির মানুষের ঐক্য ধবংস করার জন্য একটা অংশ চক্রান্ত করছে৷ এই ব্যাপারে সকলকে সতর্ক তাকতে সর্ষীয়ান বিধায়ক নিরঞ্জন দেববর্র্ম আহ্বান জানা৷ এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে তথ্য ও সংসৃকতি মন্ত্রী ভানুলাল সাহা বলেন, স্মৃতি সৌধ, স্মৃতি উদ্যানকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে এলাকাবাসীকে৷ এই অঞ্চলকে নিয়ে যে অতীত ও ইতিহাস জাড়িয়ে আছে তা নবীন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে মুখ্যমন্ত্রী যে পরামর্শ দিয়েছেন তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তর তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেবে৷ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তরের সচিব এম এল দে৷ তিনি জানান, ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর এই প্রকল্প রূপায়ণে তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তর উদ্যোগ নেয়৷ গোলাঘাটির কৃষক আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতিতে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয় তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তর৷ পুরো প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা৷ এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা৷ ভক্তঠাকুর ঘাটে শহীদ স্মৃতি সৌধের পাশাপাশিবুড়িমা নদীর ওপারে গড়ে তোলা হয়েছে শহীদ স্মৃতি উদ্যান৷ এই উদ্যানে রয়েছে ক্যাফেটোরিয়া, গ্রামীণ শিল্পীদের বিপনন কেন্দ্র, ওয়াচ চাওয়ার, পর্যটকদের বিশ্রাম কেন্দ্র, একটি রেস্ট হাউসে, ২টি টংঘর, ফুটব্রীজ, একটি তথ্য ও মত বিনিময় কেন্দ্র, ভিউ পয়েন্ট ইত্যাদি৷ ভবিষ্যতে এই স্মৃতি উদ্যানে শিশুদের জন্য পার্ক, মুক্ত মঞ্চ ও বালির ভাস্কর্যের যাদুঘর গড়ে তোলা হবে৷
খুমচাক কলাকেন্দ্রের অনুষ্ঠানে এই প্রকল্প নির্মানে জমি দাতাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়৷ মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার তাদের পরিবারের প্রতিনিধিদের হাতে রিসা, মানপত্র ও পুষ্পস্তবক তুলে দেন৷
প্রসঙ্গত, সেদিনের স্রোতস্বিনী বুড়িমা নদী এখন শান্ত-স্থির৷ আবহমানকালের ধারায় বুড়িমা এখনো বয়ে চলেছে৷ নদীর দু পাড়ের জীবন ধারাও বদলে গেছে৷ ভক্তঠাকুর ঘাটের সেই ব্যস্ততাও আজ আর নেই৷ ৬৯ বছর আগে এই গোলাঘানটির ভক্তঠাকুর ঘাটেই মজুতদারি ও মহাজনি অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল৷ শোষক মহাজনের কুটিল চক্রান্তে পুলিশের গুলিতে জুমিয়া ও কৃষকের রক্তে স্নাত হয়েছিল বুড়িমা নদীর ভক্তঠাকুর ঘাট৷ প্রাণ হারিয়ে ছিলেন ১২ জন কৃষক৷ সে দিনটি ছিল ২৩ আশ্বিন, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ, ৯ অক্টোবর ১৯৪৮৷ ইতিহাস মনে রেখেছে বীর শহীদদের৷ ে৷ এখানে শহীদদের স্মৃতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়৷ শহীদ স্মৃতি সৌধে একে একে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, তথ্য ও সংসৃকতি মন্ত্রী ভানুলাল সাহা, এ ডি সি র মুখ্য কার্যনির্র্বহী সদস্য রাধাচরণ দেববর্র্ম, বিধায়ক নিরঞ্জন দেববর্র্ম, বিধায়ক কেশব দেববর্র্ম, বিধায়ক নারায়ণ চৌধুরী, তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তরের সচিব এম এল দে, তথ্য ও সংসৃকতি দপ্তরের অধিকর্র্ত এম কে নাথ, সিপাহীজলা জেলার জেলাশাসক প্রদীপ চক্রবর্তী প্রমুখ৷ এরপরেই উদ্বোধন হয় শহীদ স্মৃতি পার্কের৷ উদ্বোধন করেন তথ্য ও সংসৃকতি মন্ত্রী ভানুলাল সাহা৷ উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, এ ডিসির মুখ্য কার্যনির্র্বহী সদস্য রাধাচরণ দেববর্র্ম, বিধায়ক নিরঞ্জন দেববর্র্ম, বিধায়ক কেশ্যব দেববর্র্ম প্রমুখ৷ এরপর গোলাঘাটি খুমচাক কলাকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন এ ডিসির মুখ্য কার্যনির্র্বহী সদস্য রাধাচরণ দেববর্র্ম৷